রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের বহিরাক্রমণের ভিডিও ফুটেজ যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসতে শুরু করল, তখন একটা কৌতুক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল—স্তালিনের ভূতের কাছে ভ্লাদিমির পুতিন জিজ্ঞাসা করছেন, কুরস্কের দিকে ধেয়ে চলা জার্মান ট্যাংকের ব্যাপারে এখন করণীয় কী।
স্তালিনের ভূত উত্তর দিলেন, সমাধানটা খুব সহজ। যুদ্ধক্ষেত্রে সেরা ইউক্রেনীয় ডিভিশনকে পাঠিয়ে দাও, যেমনটা আমি ১৯৪৩-এ করেছিলাম। আর আমেরিকানদের কাছে ট্যাংক ও অর্থ চাও। কিন্তু পুতিনের হাতে এই দুই বিকল্পের কোনোটাই নেই। এখন তাঁকে নিজের মাটিতে ইউক্রেনীয় সেনাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তাঁর এক নম্বর শত্রু।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী গত ১০ দিনের বেশি সময় ধরে রুশ ভূখণ্ডে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। তারা এরই মধ্যে এক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ও ৮০টি বসতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ভূখণ্ডটি শাসনের জন্য একটি সামরিক প্রশাসন চালু করেছে। রাশিয়া এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, সেই তুলনায় ইউক্রেন যতটুকু নিয়ন্ত্রণ নিল, সেটা অবশ্যই ছোট। এই সফলতা যুদ্ধের জয়–পরাজয়ের ফয়সালাও করবে না।
কিন্তু এই ঘটনা এই যুদ্ধ কীভাবে হচ্ছে এবং কীভাবে তার শেষ হবে—তা নিয়ে প্রভাববিস্তারী ভাষ্যগুলো মৌলিকভাবে বদলে দেবে।
ইউক্রেনের কুরস্ক আক্রমণ ক্রেমলিনের কৌশলনীতির একেবারে গোড়ায় গিয়ে আঘাত করেছে। ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব দ্য ওয়ারের সূত্রমতে, পশ্চিমারা ভাবতে শুরু করেছিল, ‘এই উপসংহারে আসার খোলাখুলি কারণ আছে যে ইউক্রেনে রাশিয়ার আধিপত্য করার বিষয়টি অবধারিত এবং আমাদের অবশ্যই পার্শ্বরেখায় অবস্থান করতে হবে।’
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ক্রেমলিন খুব সফলভাবেই এই বয়ান চালু করতে পেরেছিল। ফলে পশ্চিম ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিল। পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা কিয়েভকে বিধিনিষেধ দেয়। এভাবে এক হাত বেঁধে রেখে ইউক্রেনকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছিল।
এরই মধ্যে পুতিন সৈন্য সমাবেশ ও অস্ত্রশস্ত্র জড়ো করেছেন। পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে নরকের বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করছে। বিমানঘাঁটিগুলো ব্যবহার করে বোমা বর্ষণ করতে হচ্ছে। তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি, ইউক্রেনীয় বাহিনী এভাবে আক্রমণ শুরু করতে পারে। কুরস্কে আক্রমণ তাই যুদ্ধের ভাষ্যকে কিয়েভের পক্ষে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই আক্রমণ দেখিয়ে দিল যুদ্ধ অচলাবস্থায় পড়েনি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, ইউক্রেনীয় বাহিনী উল্লেখ করার মতো কয়েকটি গতিশীল অভিযান পরিচালনা করেছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজয়টি হচ্ছে কৃষ্ণসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের পথে বিজয়। তারা সেখানে রাশিয়ার নৌবহরের ৩০ শতাংশকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। অবশিষ্ট জাহাজগুলোকে রাশিয়া আজভ সাগরে তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে রাখতে বাধ্য হয়।
ইউক্রেন এত সূক্ষ্ম ড্রোন হামলা চালায় যে সেটা রাশিয়ার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ক্রিমীয় উপদ্বীপের বিমানঘাঁটির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম হয়। এটাও ইউক্রেনীয়দের বড় একটা সফলতা।
কুরস্কে ইউক্রেনের আক্রমণ এই ভাষ্যকেও ভেঙে দিল যে যুদ্ধ কেবল ইউক্রেনের মাটিতেই হবে এবং শুধু ইউক্রেন নিজের সীমানার মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান লক্ষ্য করে আক্রমণ করে যা দু-একটা জয় পেতে পারে।
ইউক্রেনকে পশ্চিমারা যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে, সেটা দিয়ে রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর ব্যাপারে অনাগ্রহ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির। এতে পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা বেড়ে যাবে, সেই ভয় রয়েছে তাদের। এ বাস্তবতায় রাশিয়ার ভেতরে হামলার জন্য নিজস্ব ড্রোনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে ইউক্রেনকে। এই সুযোগে রাশিয়া ইউক্রেনে নতুন নতুন আক্রমণ চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করে দ্রুতগতিতে দনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আশা করেছিল রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সূত্র বলছে, কুরস্ক অঞ্চলে পাল্টা হামলা চালানোর জন্য দনবাস থেকে কিছু সেনা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এই আক্রমণ রাশিয়ার ভূখণ্ডে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারের যে ট্যাবু ছিল, সেটাও ভেঙে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে পাঠানো এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের সঙ্গে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে। এটা নিশ্চিত করেই ইউক্রেনের ভূখণ্ড বিজয়ের রাশিয়ার প্রচেষ্টাকে জোরালোভাবে বাধা দেবে।
এই অধ্যায় পুতিনের জন্য অপমানের কারণ। কিন্তু ইউক্রেনের জন্য আশার বীজ বুনে দিল।
● ওরিসিয়া লুটচেভিয়া আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাংক চাটাম হাউসের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া কর্মসূচির উপপরিচালক এবং ইউক্রেন ফোরামের প্রধান
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে মনোজ দে