বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান ভালো, এখানে শ্রম তুলনামূলক সস্তা। ফলে কোনো ধরনের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ছাড়াই চামড়াশিল্পের বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। এরপরও কেন চামড়াশিল্পের বিকাশ হচ্ছে না, তা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু চামড়াশিল্পের কাঁচামাল কাঁচা চামড়া দেশেই উৎপাদিত হয়, যার গুণগত মানও বেশ ভালো। আমদানিনির্ভর পোশাক খাত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ। অথচ রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশে উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প বিকশিত হতে পারেনি।
বাংলাদেশ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যার জন্য ১ হাজার ৫৯৯ কোটি ডলারের তুলা, সুতা, কাপড়, সরঞ্জামসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে। অন্যদিকে দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল থাকার পরও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি মাত্র ১২২ কোটি ডলার। এ সময় চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৬৮ বিলিয়ন বা ৪৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র দশমিক ২৬ শতাংশ। (চামড়াপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনার পথে এখনো বড় বাধা দূষণ, প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি ২০২৪; পোশাকে মূল্য সংযোজন আসলে কত, প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট, ২০২৩)
বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও দেশীয় চামড়াশিল্পের বিকাশ না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দেশের চামড়াশিল্পের কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) এক গবেষণা অনুসারে, এ জন্য যেসব কারণ দায়ী, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) সক্ষমতার অভাব, কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে ট্যানারিমালিকদের যথাযথ ধারণা না থাকা, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান উন্নত না হওয়া।
এসব কারণে চামড়াশিল্পের মানসনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছে না সাভারে অবস্থিত ট্যানারিগুলো। ফলে দেশে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে। (‘জাতীয় সম্পদ চামড়াশিল্প রক্ষার্থে কমপ্লায়েন্স অর্জনে করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন, বিসিক, জুন ২০২৩, পৃষ্ঠা: ৪-৫)
দেশের চামড়াশিল্প কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এত পিছিয়ে আছে যে বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬; অথচ এ সংখ্যা ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি। এলডব্লিউজি সনদ না থাকার কারণে চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। দেশীয় কাঁচা চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়, যা কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে।
এর কারণ হলো, বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে চামড়াজাত পণ্যের অর্ডার নিলে তারা এলডব্লিউজি সনদ থাকা প্রতিষ্ঠানের চামড়া দিয়ে পণ্য বানানোর শর্ত দিয়ে থাকে। (চামড়া খাতে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ অর্জনে করণীয়-বিষয়ক প্রতিবেদন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), সেপ্টেম্বর ২০২৩, পৃষ্ঠা-১)
মূলত পরিবেশদূষণ ও অনুন্নত কর্মপরিবেশের কারণে দেশীয় চামড়াশিল্পে এমন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে একদিকে কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন চামড়া ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে এতিমখানা, মাদ্রাসা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষেরা, অন্যদিকে অনেক দেশীয় চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে বিদেশ থেকে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে। গত এক দশকে চামড়ার জুতা থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও বিস্ময়করভাবে কাঁচা চামড়ার দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।
এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। এ ছাড়া খাসির প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা। (ঢাকায় প্রতি বর্গফুট চামড়ার সর্বোচ্চ দাম ৬০ টাকা, বাইরে ৫৫, ইত্তেফাক, ৩ জুন ২০২৪) অথচ ১১ বছর আগে ২০১৩ সালে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৮৫ থেকে ৯০ টাকা আর খাসির চামড়ার দর ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। (এবার চামড়ার ভালো দাম মিলবে, প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর ২০১৩)
কিন্তু চামড়াশিল্পের দূষণের সমস্যা তো আজকের নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এ সমস্যা চলে আসছে। হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলত। বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ কমাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বিসিকের নেতৃত্বে সাভারের হেমায়েতপুরে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় চামড়াশিল্প নগর, যার মধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণে। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হলেও এ শিল্প দূষণমুক্ত হয়নি। কারণ, বিপুল অর্থ ব্যয় করে দুই বছরের বদলে নয় বছর সময় নিয়ে নির্মিত সিইটিপি চামড়াশিল্পের সব ধরনের বর্জ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধনে সক্ষম নয়। (বিসিক, ২০২৩, পৃষ্ঠা-২)
এ বিষয়ে বিডার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সিইটিপির তরল বর্জ্য পরীক্ষা করে নির্গত তরল বর্জ্যের অনেকগুলো প্যারামিটার পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩-এর নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। প্যারামিটারগুলো হলো সিওডি, টিডিএস, ক্রোমিয়াম, বিওডি, ডিও, টিএসএস ইত্যাদি। তা ছাড়া কাগজে-কলমে সিইটিপির দৈনিক পরিশোধনের ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার বলা হলেও ২০১৯ সালে এলডব্লিউজি কর্তৃক চালানো এক পরীক্ষায় প্রকৃত পরিশোধনের ক্ষমতা পাওয়া যায় মাত্র ১৪ হাজার ঘনমিটার। অথচ চামড়াশিল্প নগরীতে অবস্থিত ট্যানারিগুলোর উৎপাদনক্ষমতা দৈনিক সর্বোচ্চ ৭৬৬ টন ওয়েট ব্লু এবং ১৪২ টন ক্রাস্ট/ফিনিশড লেদার। সে হিসাবে স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, পানি ব্যবহৃত হলে দৈনিক প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদন হওয়ার কথা।
তা ছাড়া পবিত্র ঈদুল আজহার পরবর্তী ৩ মাসে দৈনিক ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত তরল বর্জ্য তখন সারফেস ড্রেনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে নির্গমন করা হয়। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত বিষাক্ত ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম পরিশোধনের জন্য যে কমন ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে, সেটাও কার্যকর নয়।
এ ছাড়া সাভারের চামড়াশিল্প নগরে দৈনিক ২০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্লাজ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (এসপিজিএস) না থাকায় উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদভাবে ৬ একর আয়তনের একটি ডাম্পিং জোনে গর্ত করে জমা করা হয়। ফলস্বরূপ চামড়াশিল্পের কারণে এখন বুড়িগঙ্গার বদলে সাভারের ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে এবং চামড়াশিল্প পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেট পাচ্ছে না। (বিডা ২০২৩, পৃষ্ঠা-৭-৮)
তবে এলডব্লিউজি সনদ না পাওয়ার ক্ষেত্রে সিইটিপি বা বিসিকের সক্ষমতার সমস্যা ছাড়াও ট্যানারিমালিকদেরও দায় রয়েছে। বিসিক ও বিডার গবেষণা অনুসারে, এলডব্লিউজি কর্তৃক চামড়াশিল্পের পরিবেশগত মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ১৭টি বিষয়ে ১ হাজার ৭১০ নম্বর রয়েছে, যার মধ্যে ৩০০ নম্বর কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত। বাকি ১ হাজার ৪১০ নম্বর রয়েছে জ্বালানি খরচ, পানির ব্যবহার, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা, চামড়ার উৎস শনাক্তকরণ, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মান ইত্যাদি বিষয়, যেগুলোর মানদণ্ড রক্ষা করা ট্যানারিমালিকদের দায়িত্ব। (বিসিক ২০২৩, পৃষ্ঠা-৫০; বিডা ২০২৩, পৃষ্ঠা-৬)
উদাহরণস্বরূপ পানির ব্যবহারের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিমালা ২০২৩ অনুসারে, প্রতি টন কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে পানি নির্গমনের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩০ ঘনমিটার বা ৩০ টনের মধ্যে সীমিত থাকার নিয়ম থাকলেও ট্যানারিগুলোয় ৫০ থেকে ৬০ টন পানি ব্যবহার করা হয়, যার ফলে পানির অপচয় হয় এবং সিইটিপির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। (পলিউশন ফ্রম ট্যানারিজ ইন সাভার অন রাইজ, নিউ এজ, ১৫ জুলাই ২০২২)
ট্যানারিমালিকদের আরও যেসব সমস্যা এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে বাধা, তার মধ্যে রয়েছে কাঁচা চামড়ার উৎস ও প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়ার গন্তব্য শনাক্তকরণের ব্যবস্থা (ট্রেসিবিলিটি) না থাকা, তরল বর্জ্যের সঙ্গে ক্ষুদ্রাকৃতির কঠিন বর্জ্য একই পাইপলাইনে অপসারণ, ট্যানারির ডিজাইন ক্যাপাসিটির অতিরিক্ত চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, ট্যানারিগুলোর ন্যূনতম প্রিট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা না থাকা, রাসায়নিক দ্রব্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা, ক্রোমযুক্ত বর্জ্য আলাদা না করা, আধুনিক পদ্ধতিতে চামড়া প্রক্রিয়াকরণের ধারণা না থাকা, শ্রমিকদের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের অভাব ইত্যাদি। (বিসিক ২০২৩, পৃষ্ঠা-৩০-৩১; বিডা ২০২৩, পৃষ্ঠা-৯)
দেশের চামড়াশিল্পের টেকসই বিকাশ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো শ্রমিকদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারা। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরে পরিবেশদূষণের সমস্যার মতো কর্মপরিবেশের সমস্যারও সমাধান হয়নি। পরিবেশদূষণের প্রভাব পড়ছে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, আয় ও কর্মপরিবেশের ওপর। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন সলিডারিটি সেন্টারের এক গবেষণা অনুসারে, পরিবেশগত দূষণের জন্য ৭০ শতাংশের বেশি শ্রমিক নানা সমস্যায় ভোগেন। (ট্যানারির পরিবেশদূষণের শিকার হচ্ছেন শ্রমিকেরা, প্রথম আলো, ১ মে ২০২৩)
বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন ও গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের যৌথভাবে করা এক জরিপ অনুসারে, জরিপে অংশ নেওয়া ৯৫ শতাংশ শ্রমিকেরই কোনো নিয়োগপত্র নেই। অর্ধেকের বেশি শ্রমিক সরকারঘোষিত ন্যূনতম মজুরি ১৩ হাজার ৫০০ টাকার কম মজুরি পান, শ্রমিকদের দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়, ওভারটাইম করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে ও শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়নের অভাবে মালিকপক্ষের খেয়ালখুশিমতো আচরণ সহ্য করতে হয়।
পরিবেশদূষণ ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশের কারণে শ্রমিকেরা চর্মরোগ (২৮%), শ্বাসকষ্ট (১৩%), পেটের পীড়া (৩২%) ও মাথাব্যথার (৬৩%) মতো সমস্যায় ভোগেন। জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের তিন-চতুর্থাংশই কোনো ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই কাজ করেন এবং ৭৯ শতাংশেরই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সময় ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ওপর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। (রিপোর্ট: এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস ইন বাংলাদেশ’জ লেদার ইন্ডাস্ট্রি, টুগেদার ফর ডিসেন্ট লেদার, সেপ্টেম্বর ২০২২)
ট্যানারিমালিকেরা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে নিজেদের আওতার মধ্যে থাকা পরিবেশ ও শ্রম অধিকারবিষয়ক কমপ্লায়েন্সগুলো রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন হলে তা এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতো। ট্যানারিগুলো নিজস্ব ইটিপি বসিয়েও পরিবেশসম্মতভাবে চামড়া উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারে।
বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান ভালো, এখানে শ্রম তুলনামূলক সস্তা। ফলে কোনো ধরনের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি ছাড়াই চামড়াশিল্পের বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু সরকারের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শিতা; চামড়াশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের পরিবেশ ও শ্রম অধিকারকে গুরুত্ব না দিয়ে স্বল্প মেয়াদে মুনাফা করাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে এই শিল্পের বিকাশ আটকে আছে। সরকার ও চামড়াশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও ট্যানারিমালিকেরা যত দিন না তা উপলব্ধি করছেন, তত দিন চামড়াশিল্পের এ সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান হবে না।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক