৭ নভেম্বর না হলে বিএনপির জন্ম হতো না

১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বরে সামরিক অভ্যুত্থান, জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড, পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান— একের পর এক ঘটনা ঘটে। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিএনপির জন্মের যোগসূত্র নিয়ে লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে যায়। একদিকে বাকশাল তথা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা, অন্যদিকে আর সব রাজনৈতিক দল—এ রকম একটা সমীকরণ তৈরি হয়। যে জনতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালে দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন, চার বছরের মাথায় তাঁকে তাঁরা ছুড়ে ফেলে দিলেন। কেন এমন হলো?

অধ্যাপক আহমদ শরীফের একটি উক্তি দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করব। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবকে যারা হত্যা করল, তারা গোড়ায় সবাই মুজিবের অনুগত ছিল। … শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের দুঃশাসন কিন্তু হত্যা-লুণ্ঠনের বিভীষিকা, যা মুজিবকে গণশত্রুতে পরিণত করেছিল’ (সূত্র: আহমদ শরীফের ডায়েরি: ভাব-বুদ্বুদ)।

মুজিব অনুসারীরা কখনো এটি খতিয়ে দেখেননি। তাঁরা সব সময় এটাকে ব্যাখ্যা করেছেন ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে। বললে অত্যুক্তি হবে না, শেখ মুজিবকে পাকিস্তানিরা মারেনি। তিনি নিহত হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হাতে। ক্ষমতাসীন বাকশালের বাইরে সব রাজনৈতিক দল চেয়েছিল শেখ মুজিবের পতন। অনুঘটকের কাজটা করল সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট। সেনানেতৃত্ব এটি সমর্থন করল। ফলে এটি হয়ে দাঁড়াল একটি সামরিক অভ্যুত্থান।

সামরিক অভ্যুত্থান এ দেশে নতুন নয়। পাকিস্তান শাসনামলে এটি দুবার হয়েছে—১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে। শাস্ত্রমতে, যখন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন করা যায় না, তখন দেশের ক্ষমতাধর কোনো গোষ্ঠী এ রকম অভ্যুত্থান ঘটিয়ে থাকে। আর কে না জানে, দেশের সবচেয়ে সংগঠিত, প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রবলে বলীয়ান প্রতিষ্ঠান হলো সামরিক বাহিনী।

এ বাহিনীর কেউ যদি মনে করেন দেশ ঠিকমতো চলছে না, রাজনীতিবিদদের আচরণ ভালো নয়, তাঁরা গণেশ উল্টে দেন। তবে পাকিস্তানি স্টাইলের সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের একটি বড় পার্থক্য আছে। পাকিস্তানের দুটি অভ্যুত্থানই ছিল ‘রক্তপাতহীন’। বাংলাদেশেরটা রক্তাক্ত। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে অনেক রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। 

■ জাসদ চেয়েছিল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী সরকার, যেখানে জাসদ ভূমিকা রাখবে। ■ জিয়াউর রহমান নিজের অবস্থান সংহত করার পর জাসদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নেন।

১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান বিষয়ে সেনাবাহিনীর অনেকে অবগত থাকলেও সবার অংশগ্রহণ ছিল না। সেনাবাহিনীতে দলাদলি ছিল। এর সূত্রপাত ১৯৭১ সালে। ওই সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যেমন জমিদারি স্টাইলে দিন কাটিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররাও অনেকে ছিলেন ওয়ারলর্ডের মতো। 

স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক সরকার তাদের মধ্যে বিভাজন জিইয়ে রেখেছিল। ভেবেছিল, এভাবেই দিন যাবে, কিন্তু সেটি হয়নি। অন্তঃকোন্দল সত্ত্বেও পুরো সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ দাবি করত, তারাই দেশটা স্বাধীন করেছে। 

আরও পড়ুন

সেনানেতৃত্ব মনে করত, আওয়ামী লীগের নেতারা কলকাতা-আগরতলায় বসে আমোদ ফুর্তি করে দিন কাটিয়েছেন। রণাঙ্গনে ছিলেন সেনারা। তাঁরাই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। সুতরাং দেশ পরিচালনা করার অধিকার তাঁদেরও আছে। কিন্তু তাঁরা নিদারুণ অবহেলার শিকার হয়েছেন। শেখ মুজিব দেশ শাসন করেছেন তাঁর দল আর রক্ষীবাহিনী দিয়ে, ভারতের সমর্থন নিয়ে।

সেনা মনস্তত্ত্বে মুজিব ও ভারতবিরোধিতা সমার্থক ছিল। ১৫ আগস্টের পর তারা ভাবল, বাংলাদেশ ‘সার্বভৌম’ হয়েছে। সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন এল। সেনাপ্রধান হলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভোরে সেনাবাহিনীর আরেকটি অংশ অভ্যুত্থান ঘটায়। নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সেনা কর্মকর্তারা দেশত্যাগ করলেন। জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে খালেদ হলেন সেনাপ্রধান। পরলেন মেজর জেনারেলের ব্যাজ।

এ অভ্যুত্থানের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এক অর্থে বলা যায়, মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ছিল এই অভ্যুত্থান। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অনুসারীরা এটিকে তাঁদের বিজয় হিসেবে দেখলেন। তাঁদের ছাত্রসংগঠন মিছিল করে উল্লাস করল। জনমনে ধারণা হলো, বাকশালের শাসন বুঝি আবার ফিরে এল। তাঁদের প্রতি তাঁদের দলের বাইরে সাধারণ মানুষের কোনো সহানুভূতি ছিল না।

সেনাবাহিনীর সাধারণ সেনারা ফুঁসে উঠলেন। ৭ নভেম্বর সেনাবিদ্রোহ হলো। এই অঞ্চলে এ রকম একটি বিদ্রোহ হয়েছিল ১৮৫৭ সালে, যেখানে সাধারণ সেনারা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বন্দুক তাক করেছিলেন। কর্মকর্তারা সবাই ছিলেন ইংরেজ।

৭ নভেম্বরের সেনা অভ্যুত্থানে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের পতন হলো। তবে ১৫ আগস্ট-পরবর্তী অবস্থাটি হুবহু ফিরে এল না। আগের আধা সামরিক শাসনের বদলে এবার এল নির্ভেজাল সামরিক শাসন। ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে গেলেন জিয়াউর রহমান। একসময় তিনি হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে রাষ্ট্রপতি।

৭ নভেম্বরের আরেকটি পক্ষ ছিল। এটি হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। ১৯৭২ সালের জন্মলগ্ন থেকেই জাসদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল মুজিব সরকারের উৎখাত। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা সেনাবাহিনীর ভেতরে সাধারণ ও নিচু পদের সেনাসদস্যদের সংগঠিত করতে থাকে। তৈরি হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। শুরুতে এটি দেখভাল করতেন জাসদের প্রথম সভাপতি মেজর (অব.) এম এ জলিল। ১৯৭৪ সালে তিনি গ্রেপ্তার হলে এটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেন লে কর্নেল (অব.) আবু তাহের। 

তাহের ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের অংশ ছিলেন। অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনী ও জাসদের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী। ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর তিনি তৎপর হলেন। সক্রিয় হলো বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। জাসদের সামরিক সংগঠন বিপ্লবী গণবাহিনীও তৎপর হয়। 

জাসদের শীর্ষ নেতারা জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেন। সাধারণ সেনাসদস্যদের স্বার্থের দিকটি বিবেচনা করে ও কিছু রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে তৈরি করা হয় ১২ দফা দাবি। তার ১০ নম্বর দফাটি ছিল উল্লেখযোগ্য। এই দফায় বলা হয়েছিল, আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত যেসব সেনা কর্মকর্তা ৩ নভেম্বর বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হবে। 

৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের সময় জিয়াউর রহমানকে অন্তরিণ করা হয়েছিল। তিনি সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁকে ঘরে আটকে রেখে খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধান হওয়ার বিষয়টি সেনাসদস্যরা ভালোভাবে নেননি। ৬ নভেম্বর রাতে বিভিন্ন ইউনিটে তাঁরা বিদ্রোহ করেন। আবু তাহেরের লোকেরা ঢাকা সেনানিবাসে পৌঁছানোর আগেই জিয়ার অনুগত সেনারা তাঁকে মুক্ত করে ফেলেন।

জাসদ চেয়েছিল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী সরকার, যেখানে জাসদ ভূমিকা রাখবে। সেনানেতৃত্বের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিপ্লব নিয়ে জিয়াউর রহমানের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। উপরন্তু, তাঁরা জাসদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এটিকে দুর্বল করে দেওয়ার অভিযোগ আনলেন।

জিয়াউর রহমান নিজের অবস্থান সংহত করার পর জাসদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নেন। একপর্যায়ে আবু তাহেরসহ জাসদ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনীর শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। আদালত আবু তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। আবু তাহেরের ফাঁসি হয়।

৩ থেকে ৭ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত একটা ত্রিমুখী লড়াইয়ে জিয়াউর রহমান ও আবু তাহের ছিলেন এক পক্ষ এবং খালেদ ছিলেন উভয়ের প্রতিপক্ষ। ৭ নভেম্বর সকালে খালেদ বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের হাতে নিহত হন। তিনি দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ার পর সেনানেতৃত্বের সঙ্গে জাসদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। এ দ্বন্দ্বে জিয়াউর রহমানের জয় হয়। জাসদ হেরে যায়।

জিয়াউর রহমান অবশ্য একটি কাজ করেন; তিনি ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাননি। তাঁদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে দেশের বাইরে রাখার বন্দোবস্ত করেন। তাঁদের মধ্যে দুজন খন্দকার আবদুর রশিদ ও সৈয়দ ফারুক রহমান চাকরি নেননি। তাঁরা ক্ষমতার রাজনীতিতে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তাঁরা দেশে ফিরে এলেও জিয়াউর রহমান তাঁদের আবার বাইরে পাঠিয়ে দেন। ফারুক রহমান আবারও দেশে এসে বিদ্রোহের চেষ্টা করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 

ধীরে ধীরে জিয়াউর রহমান হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। এতে যোগ দেন অনেক নামীদামি আমলা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও দলছুট রাজনৈতিক নেতা। 

বাকশাল তথা আওয়ামী লীগ ব্যাকফুটে চলে যাওয়ার কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেটি পূরণ করে বিএনপি। বিএনপি আওয়ামীবিরোধী মনস্তত্ত্ব উগরে দিতে দুটি কার্ড সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করে, আর সেগুলো হলো ইসলাম ও ভারত। বিরাট একটি সমর্থকগোষ্ঠী পেয়ে বিএনপি ভালো রকমেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

৭ নভেম্বর না হলে জিয়াউর রহমানের উত্থান হতো না। বিএনপির জন্ম হতো না। হয়তো অন্য কিছু হতো। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান এ দেশে বিএনপির রাজনীতির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। বিএনপি এই দিনটিকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করে।

৭ নভেম্বরের ভিত্তি ছিল ১৫ আগস্ট। ১৫ আগস্ট না হলে ৩ ও ৭ নভেম্বর হতো না। বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের দুটি পিলার তৈরি করে দিয়েছে ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বর। এ দুটি ছিল ‘বাকশালি রাজনীতি’র সঙ্গে ছেদ ঘটানোর দিন। ১৫ আগস্ট রাজনীতির জরায়ুতে যে ভ্রূণের জন্ম হয়েছিল, ৭ নভেম্বর সেটি আরও পরিপুষ্ট হয়। তার পরম্পরায় ভূমিষ্ঠ হয় বিএনপি।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক