ভেবেছিনু মনে যা হবার তারি শেষে
যাত্রা আমার বুঝি থেমে গেছে এসে
নাই বুঝি পথ, নাই বুঝি আর কাজ,
পাথেয় যা ছিল ফুরায়েছে বুঝি আজ,
যেতে হবে সরে নীরব অন্তরালে
জীর্ণ জীবনে ছিন্ন মলিন বেশে।
গীতাঞ্জলিতে মৃত্যুর কাছে এমন অসহায় সমর্পণ আমরা দেখি। হাহাকার জাগানিয়া। কিন্তু সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্যের সমর্পণ ছিল গৌরবময়। মৃত্যু নিঃসন্দেহে যন্ত্রণার, তাঁর মৃত্যু ছিল আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু সেই মৃত্যুকে তিনি করে গেছেন ঐশ্বর্যময়। তার ডাকনামের সঙ্গেই সমার্থক হয়ে ওঠে মৃত্যুটাও।
মাত্র বিশ বছর বয়সে জীবনপথের যাত্রা থেমে গেল সারাহ ইসলামের। সদ্য কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে ওঠা মেয়েটি আর নেই। ফুলের মতো উচ্ছল মেয়েটি আজ খসে পড়া নক্ষত্র। যে যন্ত্রণাদায়ক রোগ তিনি দীর্ঘদিন ধরে বহন করে আসছিলেন, সেখানেই মৃত্যুই ছিল যেন তাঁর শেষ গন্তব্য। এ ছাড়া তাঁর কোনো পথ না থাকলেও, কাজ কিন্তু ঠিকই ছিল আর সেটি তিনি দেখিয়ে গেছেন। করেও গেছেন। সারাহ ইসলামের ছোট্ট এ জীবন জীর্ণ ছিল না। ছিন্ন মলিন বেশে নয়, তাঁর এ প্রস্থান ছিল উজ্জ্বল।
সারাহ ইসলাম মৃত্যুর সময় তাঁর দুইটি কিডনিই দান করে গেছেন। দুইটি কর্নিয়াও। তাঁর দুইটি কিডনি দুজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। দুজনই নারী। এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসাজগতে প্রথমবারের মতো একটি ঘটনা ঘটে গেল। দেশে এ প্রথম ব্রেইন ডেথ থেকে মৃত্যুর আগে কোনো ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলো অন্য ব্যক্তির দেহে। ভারতে সাত-আট বছর আগ থেকে এ কাজ শুরু হয়। আমাদের দেশে কয়েকবার চেষ্টা করেও হয়ে ওঠেনি। এবার সেটি সম্ভব হলো এবং আমরা পেয়ে গেলাম মৃত্যুকে জয় করে নেওয়া একজন সাহসিনীকে।
এ কিডনি প্রতিস্থাপনের ঘটনাটি তখন ঘটল, যার কয়েকদিন আগে আমরা চট্টগ্রাম নগরীতে কিডনি রোগী ও তাঁদের স্বজনদের বিক্ষোভ দেখলাম। ডায়ালাইসিসের ফিতে সরকারের ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিল তাঁদের সেই কর্মসূচি। সেখানে পুলিশ অমানবিকভাবে হামলা চালায়। তাঁদের মারধর করে।
এমনকিও মামলাও দেয়। গ্রেপ্তার করে এক কিডনি রোগী মায়ের একমাত্র ছেলেকে। এ নিয়ে গোটা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হলো। কারাবন্দী ছেলের মায়ের কান্না সবাইকে স্পর্শ করল। অবশেষে জামিন পেলেন সেই তরুণ। পরে তাঁর ওপরে পুলিশি নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রও প্রকাশ পায়। পরে সরকারও তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে।
এ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে আমরা কিডনি রোগীদের অসহায়ত্বের কথা জানতে পারি। কী দুর্বিষহ সেই জীবন। কত কত পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয় এই একটি রোগ। একসময় সচ্ছল ব্যক্তিকেও সবকিছু হারিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নামতে হয়। একই সাথে সপ্তাহে কয়েকটি ডায়ালাইসিসের ফি আর পরিবার চালানোর খরচ; মানুষের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর উপায় থাকে না তখন। সেই মানুষগুলোর জন্যই যেন আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে গেলেন সারাহ ইসলাম। তিনি দেখিয়ে গেলেন, মৃত্যুও কীভাবে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠতে পারে।
এক সময় এ দেশে রক্ত দানে কত অনীহা ছিল। রক্ত দিতে মানুষ ভয় পেতো। সামাজিক বা ধর্মীয়ভাবেও বিষয়টিকে সহজে মেনে নিতে পারতো না। কিন্তু সেই রক্তদান এখন পানির মতো সহজ হয়ে গেছে বলা যায়। এখন আর রক্তদানে উৎসাহ করতে টিভিতে বিজ্ঞাপনও দেওয়া লাগে না। ভয় কাটিয়ে মানুষ নিজের পকেটের টাকা খরচ করে আরেকজন মুমূর্ষু মানুষকে রক্ত দিয়ে আসে। কত সামাজিক সংগঠন, এমনকি ধর্মীয় সংগঠনও এখন স্বেচ্ছায় রক্তদানের কর্মসূচি পরিচালনা করে। যে কোনো দুর্ঘটনায় হতাহতের প্রাণ বাঁচাতে রক্ত দেওয়ার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে, এমন দৃশ্যও অসংখ্যবার আমরা দেখেছি। এই রক্তদানের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন কত কত মানুষ প্রাণ ফিরে পাচ্ছে, তার হিসাব নেই।
একইভাবে মরণোত্তর চক্ষুদানের বিষয়টিও এখন ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পাচ্ছে, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠছে। এর ফলে চোখের আলো ফিরে পাচ্ছে অনেকে। অন্ধত্বকে জয় করে পৃথিবীর রূপ–সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছে। যেভাবে সারাহ ইসলামের দান করে যাওয়া দুটি কর্নিয়া দুজন ব্যক্তির চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছে। আর মানুষকে কিডনি দানে উৎসাহিত করতে তো তিনিই পথ দেখিয়ে গেলেন। জীবিত মানুষের কিডনি বেচাকেনার অবৈধ ও ভয়াবহ ব্যবসাও নিশ্চয়ই বন্ধ হবে একদিন। এর মাধ্যমে মানুষের অঙ্গহানি ও প্রতারিত হওয়াও থামবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিডনি ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকেরা এ কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। সেইসব চিকিৎসককে প্রাণঢালা অভিবাদন। তাঁরাও হলেন দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে ইতিহাসের অংশ।
দেশে প্রথম এ ধরনের অস্ত্রোপচার উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিএসএমএমইউতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে চিকিৎসকদের সঙ্গে সারাহ ইসলামের মা শবনম সুলতানাও উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সারাহ সত্যি সত্যি স্বর্গীয় সন্তান ছিল। যেখানে যেত, ব্যবহার দিয়ে সবাইকে মোহিত করে রাখত। ও বলেছিল, ‘‘আমার সবকিছু গবেষণার জন্য দিয়ে দিতে পারো মা।’’ সারাহর ইচ্ছা ছিল, ওর ব্রেন নিয়ে গবেষণা হোক।’
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য শেষ করার আগে বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথম অঙ্গদাতা সারাহ ইসলামের নাম চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর এ ত্যাগের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হবে। অনেক মানুষ নতুন জীবন পাবে।’
সারাহ ইসলামের স্নিগ্ধ মুখাবয়বটি বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে। গত কয়েকদিন ধরে তিনি ক্লিনিক্যালি ডেড ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি জানাজানিও হলো। অনেক তাঁর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু পরিবারের ও বন্ধুবান্ধবের সেই আশাকে উপেক্ষা করে চলে গেলেন তিনি। অন্যদিকে চার ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দিলেন জীবনের আশা। ভবিষ্যতের আরও অসংখ্য মানুষের জন্য জ্বালিয়ে গেলেন আশার প্রদীপ।
আমরা অনেকে তরুণদের নিয়ে হতাশা প্রকাশ করি। সেই হতাশাকেই যেন ভেঙে চুরমার করে দিলেন সারাহ ইসলাম তাঁর তারুণ্যের শক্তি দিয়ে। একটা সুন্দর মানবিক সমাজ তো তরুণেরাই দেখাতে পারেন। সেটিই যেন প্রমাণ করে গেলেন তিনি।
অল্প বয়সেই দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত হন সারাহ। রোগটি নিয়েই ছোট্ট একটি জীবন কাটিয়ে দিলেন। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। জড়িত ছিলেন সামাজিক কাজে। শিশু-কিশোরদের পত্রিকা কিশোর আলোর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। সুন্দর ছবি আঁকতেন তিনি। তাঁর ফেসবুক আইডিতে ঢুকলে তাঁর আঁকা ছবি আর কার্টুন দেখে মুগ্ধ হতে হয়।
প্রতিনিয়ত জীবন–মরণ যুদ্ধেই ছিল সারাহ লড়াই। এমন এক মুহুর্তে গত ২২ এপ্রিল ২০২২ তাঁকে নিয়ে মা শবনম সুলতানা ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। চলুন সেটি পড়ি: ‘সেই অকুতোভয় মেয়েটি যে কিনা বরাবরই রক্ত শূন্যতায় ভোগে... সে কিনা কারো জরুরি রক্তদানের প্রয়োজনে ছুটে চলে যেতো রক্তের সন্ধানে.. ক্লাসে কারো বমি হচ্ছে সবার আগে সেই ছুটে যায়, স্কুলের টয়লেটে পড়ে থাকা আরেকটি মেয়ের রহস্যজনক মৃত্যুতে সে-ই প্রতিবাদ করে সবার আগে..বেশ কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া সড়ক আন্দোলনের সময়ও সে রাস্তায়...এ দেশে নারীরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কেন নিরাপদে পথ চলতে পারবে না! সেই প্রতিবাদে মশাল জ্বালিয়ে গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সড়কে সবার সাথে ও তো থাকবেই। এ রকম আরও কত প্রতিবাদ কত আন্দোলন!...মেয়েটি এখন লড়ছে ওর জীবন মরণ যুদ্ধে।’
সত্যিই তো, এমন মেয়ে না হলে কি মৃত্যুতেও এ কাজ করে যাওয়া সম্ভব! আচ্ছা, কবিতার বাইরেও মৃত্যু কি কখনো সুন্দর হতে পারে? পাঠক, এর উত্তর নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনারা জেনে গেছেন।
সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য, আপনাকে স্যালুট। বাংলাদেশ আপনাকে মনে রাখবে।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ইমেইল: [email protected]