বাজেট প্রতিবছর জুন মাসে আসে। শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন, নববর্ষ নিয়ে আমরা যতই মাতামাতি করি না কেন, আমি দেখেছি, নববর্ষ জিনিসটা এক বছরের বেশি টেকে না। বাজেট নিয়েও একই কথা বলা যায়, বাজেট নিয়ে আমরা যতই কথা বলি না কেন, এই জিনিস এক বছরের বেশি টিকবে না।
তবে অন্যভাবেও বলা যায়, একই বাজেট প্রতিবছরই পড়া হয়। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। এ বছর অবশ্য বাজেট করা বেশ কঠিন, কারণ টাকা নেই। টাকা যাবে বিদেশি ঋণ শোধ করতে, তেল কিনতে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। নুন আনতে পান্তা ফুরাবে, পান্তা আনতে নুন।
গরিব মানুষেরা মধ্যপ্রাচ্যে বা দূরপ্রাচ্যে গিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে দেশে যে ডলার পাঠান, আমাদের বড়লোকেরা সেসব আবার পাঠিয়ে দেন সিঙ্গাপুর, কানাডা, আরব আমিরাত কিংবা সুইজারল্যান্ড, পানামায়।
মানসিক হাসপাতালের রোগী সুস্থ হয়েছেন কি না, দেখার জন্য নাকি একটা পরীক্ষা আছে। এটা ড্রামের তলা নেই। রোগীকে বলা হয়, এই ড্রামটা পানি দিয়ে ভরো। যিনি সুস্থ, তিনি প্রথমেই বলেন এই ড্রাম ভরবে না। আর অসুস্থরা পানি ঢালতেই থাকেন।
আমাদের অর্থনীতির তলা ফুটো। অর্থমন্ত্রী আমাদের ওপরে পরোক্ষ কর বসিয়ে সেটা ভরানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু ফুটো দিয়ে ডলার চলে যাবে বিদেশে।
না। আলাপটা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। হালকা করতে চাই। কৌতুক করি।
এক বাবা তার তিন ছেলেকে বললেন, ১০০ টাকা করে দিচ্ছি। এই ১০০ টাকার জিনিস কিনে প্রত্যেকে নিজের ঘরটা সন্ধ্যার মধ্যে ভর্তি করবে।
বড় ছেলে কিনল খড়। নিজের ঘরে সে খড় ছিটাল।
মেজ ছেলে কিনল তুলা। নিজের ঘরে সে তুলা ওড়াল।
ছোট ছেলে কিনল মোমবাতি। সন্ধ্যায় সে ঘরটা আলো দিয়ে ভরে ফেলল।
বক্তা বললেন, আমাদের এমপি সাহেব হলেন সেই ছোট ছেলে। যিনি আলো দিয়ে দেশ ভরে তুলছেন।
একজন শ্রোতা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এমপি সাহেব, বাকি ৯৯ টাকা কোন ব্যাংকে রাখলেন? সুইস ব্যাংকে, নাকি পানামায় অফশোর বিনিয়োগে?
বাজেট নিয়ে এর আগেও গদ্যকার্টুন লিখেছিলাম। সেখান থেকে খানিকটা উদ্ধার করি:
আপনি কি এই উপদেশগুলো শুনেছেন?
টাকা দিয়ে ওষুধ কেনা যায়, স্বাস্থ্য নয়।
টাকা দিয়ে বই কেনা যায়, জ্ঞান নয়।
টাকা দিয়ে ভবন কেনা যায়, সংসার নয়।
টাকা দিয়ে বিছানা কেনা যায়, ঘুম নয়।
টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনা যায়, সময় নয়।
টাকা দিয়ে শরীর কেনা যায়, ভালোবাসা নয়।
তাহলে আপনি দেখছেন, টাকা দিয়ে আসল জিনিসগুলোই কেনা যায় না। অর্থই সকল অনর্থের মূল। টাকা থাকা মানে ঝামেলা কিনে আনা। সম্পত্তি মানে অশেষ উদ্বেগ। এটা আপনার প্রশান্তি নষ্ট করবে, এটা আপনাকে ঘুমোতে দেবে না। সুখ দেবে না। জীবনকে উপভোগ করতে দেবে না।
আমি আপনার বন্ধু। আপনার অশান্তি-কষ্ট আমার ভাগ করে নেওয়া উচিত। প্রিয় বন্ধু, আপনার টাকাগুলো আমাকে দিয়ে দিন, এই দুঃখ-কষ্ট-অশান্তি-উদ্বেগ আমিই বহন করি। আপনি শান্তি, সুখ, জ্ঞান, ঘুম, ভালোবাসা, সময় নিয়ে শান্তিতে থাকুন। আপনার টাকা মানে সমস্ত উদ্বেগ, হতাশা, প্রেমহীনতা আমিই নাহয় বাকি জীবনটা বয়ে বেড়ালাম।
বিস্ময়করভাবে, ওপরের উপদেশগুলো আমাদের সাবেক আইজিপি সাহেব তাঁর নবাগত কলিগদের জন্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এক জীবনে মানুষের বসবাসের জন্য খুব বেশি জায়গাজমি বা ফ্ল্যাটের দরকার নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তিতে বসবাসের জন্য যেটুকু প্রয়োজন, তা-ই আপনারা করবেন।’
তলস্তয়ের ‘একটা মানুষের কতটা জমি দরকার’ গল্পটা এবার আমরা স্মরণ করব।
পাহোমের খুব জমির লোভ। সে জমি কেনে, তার জমিপ্রীতির অত্যাচারে পাড়াপড়শিদের অবস্থা খারাপ। আরও জমি চাই।
একদিন একজন এসে বলল, দূরে একজন গোত্রপতি খুব সস্তায় জমি বিক্রি করছে। পাহোম চলল সেই গোত্রপতির খোঁজে। গোত্রপতি বলল, তুমি এক দিনে যতটা দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারবে, ততটা জমি তুমি পাবে। তবে শর্ত হলো, সূর্যাস্তের আগে তোমাকে আগের জায়গায় ফিরে আসতে হবে। পাহোম সকালবেলা হাঁটতে লাগল। এই জমি আমার। এই জমি আমার। সে আরও জোরে হাঁটে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, বিকেল হয়ে আসছে। তাকে তো ফিরতে হবে। সে দৌড়াতে লাগল। সূর্য ডুবে যায়। শুরুর জায়গা আরও দূরে। সে আরও জোরে দৌড়ায়। তারপর সে মরে গেল।
তখন তাকে কবর দেওয়া হলো। ৬ ফুট জমি সে জন্য তার দরকার হলো।
হাদিস শরিফে আছে: ‘যদি আদমসন্তানকে দুই উপত্যকা পরিমাণ ধনসম্পদ দেওয়া হয়, তবুও সে তৃতীয় উপত্যকা কামনা করবে। আর মাটি ছাড়া আদমসন্তানের পেট কিছুতেই ভরবে না।’ লোভী মানুষের পেট কেবল কবরের মাটি দিয়েই পূর্ণ হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপেনের দুই বিঘা জমি চেয়েছিলেন স্থানীয় ভূস্বামী। উপেন দিতে চায়নি। তারপর?
‘পরে মাস–দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে—
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’
রাজার হস্ত যখন সমস্ত কাঙালের ধন চুরি করে, তখন উপেনদের আর কিছুই করার থাকে না। তারা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই কথা বলে:
‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক