সকালে অফিসে এসে কয়েকটি মেইল পেলাম চাকরিপ্রার্থী তরুণদের কাছ থেকে। তাঁদের উদ্বেগ আসন্ন বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে। তাঁরা প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষার অপেক্ষায় আছেন। একজন লিখেছেন, ‘২৭ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিন ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৫তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা হবে। কিন্তু বর্তমানে বিরোধী দলগুলোর টানা হরতাল-অবরোধ চলছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস, ট্রাক ও ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটছে। এ অবস্থায় ২৭ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা পরীক্ষা নেওয়া কিংবা দেওয়ার পরিবেশ কি আছে? রাষ্ট্র কি আমাদের ওই দিনগুলোতে নিরাপত্তা দিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দেবে? সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিক অথবা স্বাভাবিক পরিবেশে অন্য সময়ে এই পরীক্ষার আয়োজন করুক।’
আরেকজন লিখেছেন, ‘আমি ফেনীতে থাকি। ঢাকায় গিয়ে আত্মীয়দের বাসায় থাকতে হয়। বাসা থেকে কেন্দ্রের দূরত্ব, ঠিক সময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারব কি না, সময়মতো যানবাহন পাওয়া যাবে কি না—এসব নিয়ে চিন্তিত আছি।’ তৃতীয় শিক্ষার্থীর ভাষ্য, ‘৫ তারিখ এক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই আমাকে আরেক পরীক্ষার হলে বসতে হবে। আগে দুই পরীক্ষার মধ্যে অন্তত ৭ দিন থেকে ৩০ দিনের বন্ধ পাওয়া যেত।’
বেসরকারি খাতে চাকরির সুযোগ কম থাকায় উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা বিসিএস পরীক্ষার দিকে ঝুঁকছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার পরীক্ষার চেয়ে বিসিএস পরীক্ষাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেই পরীক্ষাও ঠিক সময়ে হতে পারছে না নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতের কারণে।
যে দেশের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি সংখ্যক তরুণ বিদেশে গিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হতে চান, যে দেশের সিংহভাগ তরুণ কথা বলা কিংবা ভোট দেওয়ার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকেন, সে দেশের ভবিষ্যৎ অনুমান করা কঠিন নয়
এই প্রেক্ষাপটে আমরা সাম্প্রতিক একটি জরিপের দিকে তাকাতে পারি। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড জাস্টিস সেন্টারের ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে ২০২৩’ জরিপে দেখা যায়, শিক্ষিত তরুণদের প্রায় অর্ধেক বা ৪২ শতাংশ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। অনিশ্চিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির বাজার তৈরি না হওয়া, গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের স্বল্পতা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগের অভাব এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা শঙ্কার কারণেই তাঁদের এ আগ্রহ।
দেশের আট বিভাগের ৫ হাজার ৬০৯ তরুণ-তরুণীর মধ্যে পরিচালিত এ জরিপে ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশই দেশ ছাড়ার কারণ হিসেবে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন। ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন, তাঁদের যে দক্ষতা রয়েছে, দেশে সে অনুযায়ী চাকরি নেই।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই মনে করেন ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ এবং ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ মনে করেন, দেশে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ কম। এ ছাড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণে দেশ ছাড়তে চাইছেন ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ-তরুণী।
এ প্রসঙ্গে ২০১৯ সালে প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপের ফলাফলের কথাও উল্লেখ করা যায়। ওই জরিপে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালে এই হার ছিল ৬৩ দশমিক ১। তরুণদের উদ্বেগের কারণ শিক্ষার দুর্বল মান ও ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা।
ইয়ুথ ম্যাটার্স জরিপে অংশ নেওয়া ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ বিশ্বাস করেন, বর্তমানে দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা নেই। অপর দিকে ৬৩ শতাংশ তরুণ মনে করেন, গত পাঁচ বছরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছেন ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়া ২৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন, দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার হ্রাস পাচ্ছে, যা সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এই জরিপের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হলো ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশকে তঁারা নিরাপদ মনে করছেন না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশে যত আন্দোলন–সংগ্রাম হয়েছে, তার সবটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তরুণেরা।
নিকট অতীতে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও আমরা তরুণদের অগ্রভাগে পেয়েছি। এখন সেই তরুণদের ৭১ শতাংশের বেশি যদি স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে গণতন্ত্রের সংকটটা কত গভীর।
জরিপে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ৭৪ শতাংশ তরুণ-তরুণী। কিন্তু তঁাদের সেই ইচ্ছা পূরণ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যেখানে তরুণদের জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেওয়াই ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে নির্বিঘ্নে তাঁরা ভোট দিতে পারবেন, সেটা আশা করা যায় না।
২০০৮ সালের পর ভোটার হওয়া সিংহভাগ তরুণই ভোট দিতে পারেননি। কারণ, ২০১৪ সালে ১৫৩টি আসনে সংসদ সদস্য হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। আর ২০১৮ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলেও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যায়নি।
রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে তরুণদের ব্যবহার করে, কিন্তু তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কীভাবে পূরণ হবে, কীভাবে তঁারা দক্ষ ও জনশক্তি হিসেবে নিজেদের তৈরি করবেন, সেসব নিয়ে ভাবে না। তরুণদের কণ্ঠ রোধে দেশে একের পর এক কালো আইন জারি হয়, বলপ্রয়োগে তাঁদের ন্যায়সংগত আন্দোলনও স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা নিতে দেখা যায় না।
যে দেশের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি সংখ্যক তরুণ বিদেশে গিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হতে চান, যে দেশের সিংহভাগ তরুণ কথা বলা কিংবা ভোট দেওয়ার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে, সে দেশের ভবিষ্যৎ অনুমান করা কঠিন নয়।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি