‘পুরো সড়ক বিভাগই লেনদেনের মধ্য দিয়ে চলছে। পরিবহন খাত ঘিরে মাফিয়া চক্র সক্রিয় আছে। এরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সড়ক কাঠামোয় দুর্বলতা আছে।’ —কথাগুলো পরপর এভাবে বলেননি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পুরোধা ও চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের করা নানা প্রশ্নে দেওয়া তাঁর উত্তরের বিভিন্ন অংশ থেকে বাক্যগুলো জড়ো করা হয়েছে (৯ অক্টোবর ২০২২)। কিন্তু কি আশ্চর্য, পড়তে গিয়ে একটুও অসামঞ্জস্য লাগে না, হোঁচট খেতে হয় না! কেননা, পুরো সড়ক ব্যবস্থাপনার যে চিত্র এখন উদ্ভাসিত, তার সারকথা এটাই। এবং এটা একজন ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা নয়, যাঁদের রোজ ‘প্রাণ হাতে নিয়ে’ সড়কে চলতে-ফিরতে হয়, তাঁরা জানেন, দুর্ঘটনা এখন কতটা ‘স্বাভাবিক ও নৈমিত্তিক’ ঘটনা। সুতরাং সত্যিকারের ‘হোঁচট’ জনগণের জন্য বরাদ্দ, তাঁদের প্রাণ যাওয়াতেও তাই কোথাও কিছু টাল খায় না। কেবল স্বজনেরা শোকে ক্ষয়ে যান, দুঃখে ভেঙে পড়েন, ন্যায়বিচার না পেয়ে গুমরে কাঁদেন।
‘আইন কার্যকর না হওয়ার পেছনে স্বার্থান্বেষী মহল বড় বাধা’—এই স্বার্থান্বেষী মহল ব্যাপারটি কী? কারা সেই মহলের বাসিন্দা কারা? একশ্রেণির অসাধু মালিক, শ্রমিক, চাঁদাবাজ? সরকারের ভেতরের কেউ কি আছে? রাজনীতির কোনো যোগ নেই এতে? ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ কথাটিতে সমস্যার ইঙ্গিত আছে, সমাধানের দিশা নেই। লেনদেনের হালুয়া-রুটি কার কার পাতে যায়, সেটাই বড় কথা।
‘সড়কের নিরাপত্তার বিষয়ে একসময় মানুষের ধারণাই ছিল না। তারা মনে করত সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের বিষয়টি নিয়তিনির্ধারিত। কিছু করণীয় নেই’—ইলিয়াস কাঞ্চনের এ কথায় তাই দ্বিমত করার কারণ ষোলো আনা ছাড়িয়ে আঠারো আনাই বিদ্যমান। একটি ব্যতিক্রম উদাহরণ দিয়েও কি প্রমাণ করা সম্ভব, আমজনতার আসলেই কিছু করণীয় আছে?
রমিজউদ্দীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর রাজপথে নেমে এসেছিল দেশের কচিকাঁচারা। তাদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস হলো। কিন্তু এ পর্যন্ত আইনটি কার্যকর হলো না। ২০১৯ সালের অক্টোবরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার পরের মাস নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর হবে। এরপর তা কোন ‘হিমঘরে’ পড়ে আছে? ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, ‘যত দূর জানি, সেই বিধি (আইন কার্যকর করার) এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে।’
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও যদি একটি আইন কার্যকর না হয়, তাহলে সে দেশের জনগণের ‘প্রাণের মূল্য’ কতটা, তার ব্যাখ্যা-বিবৃতির প্রয়োজন পড়ে না। ‘নিয়তিনির্ধারিত’ না বলতে চাইলে না বলুন, কিন্তু বিষয়টি এত কিছুর দ্বারা ‘নির্ধারিত’ যে, সেসবের সঙ্গে জনগণের ঘুরেফিরেও কোনো সংস্রব নেই। এ অবস্থাকে কেউ ‘নিয়তি’ ধরে নিলে তার সামনে নানান যুক্তি নিয়ে হাজির হওয়া যায়, কিন্তু তাঁকে পুরোপুরি নাকচ করা যায় না।
‘আইন কার্যকর না হওয়ার পেছনে স্বার্থান্বেষী মহল বড় বাধা’—এই স্বার্থান্বেষী মহল ব্যাপারটি কী? কারা সেই মহলের বাসিন্দা কারা? একশ্রেণির অসাধু মালিক, শ্রমিক, চাঁদাবাজ? সরকারের ভেতরের কেউ কি আছে? রাজনীতির কোনো যোগ নেই এতে? ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ কথাটিতে সমস্যার ইঙ্গিত আছে, সমাধানের দিশা নেই। লেনদেনের হালুয়া-রুটি কার কার পাতে যায়, সেটাই বড় কথা। পুরো ব্যবস্থা আইনের অধীন থাকলে, সবকিছু তো নিয়মমতোই চলত। যখন তা চলে না, তখন গোড়া কাঁটার কাজটি চলে মাটির নিচে, চুপিসারে। এই আড়ালের কায়-কারবার যত দিন জমজমাট থাকবে, তত দিন লোকদেখানো পানি ঢেলেও গাছ বাঁচানো যাবে না।
ইলিয়াস কাঞ্চনের কথাতেই এর প্রমাণ আছে—‘একসময় সিঙ্গাপুরেও চরম বিশৃঙ্খলা ছিল। তারা সেটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে এসেছে। এটি সম্ভব হয়েছে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে।’ ৯ অক্টোবর সকালে রাজধানীর উল্টো পথে কাঁচপুর সেতু পার হওয়ার সময় মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে অটোরিকশার পাঁচজনের প্রাণ যায়। বিকেলে সেই সেতুতে একই ভাবে উল্টো পথে অটোরিকশা চলতে দেখেন প্রথম আলোর উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়া। তিনি ‘সরকারের ‘উন্নয়ন-দর্শন’ ও পাঁচটি মৃত্যু’ (১১ অক্টোবর) নিবন্ধে তা বিশদে বলেছেন।
সুতরাং ‘অদক্ষ চালকের কারণেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে’—কথাটি যতটা সত্য, ততটাই ‘ফাঁপা’। অদক্ষ হয়েও কেন তাঁরা চালক হতে পারলেন, এই প্রশ্ন তুলতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকলে কি এমনটা হতো? হতো না। ইলিয়াস কাঞ্চনও সত্যটা দেখিয়ে দিয়েছেন—‘আমাদের চালকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই।’
সুতরাং যাঁরা শিক্ষাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, বাধ্য হয়ে যাঁদের শৈশবেই বাস-লেগুনার পাদানিতে ঝুলে পড়তে হয়, তাঁদের জীবনযুদ্ধটাকে আর কিছু না পারি, একটু সম্মান তো জানাতে পারি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা না চাইলেও চালকের সহকারী থেকে ‘চালক’ হয়ে ওঠেন।
শুধু পরিবহন খাত কেন, দেশের প্রায় সব খাতেই কি বিপুলসংখ্যক ‘অদক্ষ’ শ্রমিক (শিশুসহ) কাছ করছে না? কেন করছে? সোজা কথায়, পেটের দায়ে। সুতরাং মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার কিংবা উন্নয়ন—খিদে পেটে সব হজম হয়ে যায়! ভরা পেটে নীতিকথা বা গালগল্প কোনোটাই শুনতে খারাপ লাগে না। এক দিন কাজ না করলে পর দিন যাঁদের পেটে খিল দিয়ে থাকতে হয়, তাঁদের দোষ দেওয়া যায় যত সহজে, সত্যিকারের দোষীও ততটাই সহজে পগার পেরিয়ে যান।
হাসান ইমাম সাংবাদিক
hello. hasanimam@gmail. com