যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব পতনের দিকে বলে যখন অধিকাংশ আমেরিকান নাগরিক বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করছেন, তিনি ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগান বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমেরিকার হারানো প্রতিপত্তি ফিরিয়ে আনতে পারবেন। কিন্তু ট্রাম্পের এই ধারণা স্পষ্টতই ভুল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পতন ঠেকাতে যে প্রতিকারের কথা বলছেন, আদতে সেটিই দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পতন নিয়ে আমেরিকানদের উদ্বিগ্ন হওয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। সপ্তদশ শতকে ম্যাসাচুসেটস বে কলোনি প্রতিষ্ঠার পরপরই কিছু পিউরিট্যান খ্রিষ্টান ওই এলাকার আদি মূল্যবোধ হারানোর জন্য হায় হায় করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পুরুষেরা নতুন আমেরিকান প্রজাতন্ত্রের পতনের ভয় পেয়ে তা টিকিয়ে রাখার জন্য রোমান ইতিহাসের পাঠ নিচ্ছিলেন।
ঊনবিংশ শতকে চার্লস ডিকেন্সের পর্যবেক্ষণ ছিল, আমেরিকানরা ‘সব সময় হতাশাগ্রস্ত, সব সময় স্থবির এবং সব সময় উদ্বেগে থাকে’। ১৯৭৯ সালের একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জাতীয় পতনের আশঙ্কা তুলে ধরতে স্ট্যাচু অব লিবার্টির গাল বেয়ে অশ্রু ঝরার ছবি ছাপা হয়েছিল।
আমেরিকানরা দীর্ঘদিন ধরে ‘অতীতের সোনালি আভা’য় আচ্ছন্ন আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমেরিকার ক্ষমতা ও প্রভাব অনেক বেশি থাকলেও সেই প্রভাব সম্পর্কে অনেকে যতটা ধারণা করে থাকে, আদতে দেশটির ততটা ক্ষমতা ছিল না। প্রচুর অর্থসম্পদ থাকা সত্ত্বেও অনেক সময়ই আমেরিকা যা চেয়েছে তা পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
যাঁরা মনে করেন, আজকের বিশ্ব অতীতের চেয়ে অনেক বেশি জটিল ও অশান্ত, তাঁদের ১৯৫৬ সালের মতো সময়ের কথা মনে করা উচিত। ওই বছরটিতে হাঙ্গেরিতে একটি বিদ্রোহ দমনে সোভিয়েত যে নির্যাতন চালিয়েছিল, তা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছিল। ওই বছর সুয়েজ খাল এলাকায় আমাদের মিত্র দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল দখলাভিযান চালিয়েছিল।
অনেক আগে থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আমেরিকার পতনের ভয়কে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়। এর কারণ এই ভয় আমেরিকার রাজনীতিকে স্থূলভাবে স্পর্শ করে থাকে। এটি আমেরিকার রাজনীতিতে বিভাজন ও বিভেদের উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। কখনো কখনো পতনের শঙ্কা সুরক্ষাবাদী রাজনীতির পক্ষে কাজ করে। এটি আমেরিকার জন্য ভালোর চেয়ে মন্দটাই বেশি বয়ে এনেছে।
কখনো কখনো এই পতনের ভয় আমেরিকাকে ইরাক যুদ্ধের মতো চরমপন্থী নীতির দিকে নিয়ে গেছে। তবে আমেরিকান শক্তিকে অহেতুক ছোট করে দেখা কিংবা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের বাড়িয়ে বলার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই।
ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে অ্যাবসলিউট বা পরম পতন এবং আপেক্ষিক পতনের মধ্যে যে ফারাক আছে, সেই ফারাকটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপেক্ষিক পতনের দৃষ্টিতে বিচার করি, তাহলে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই আমেরিকার পতন ঘটেছে। সেই জায়গা থেকে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র আবার কখনই অর্ধেক বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্তা হবে না এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর একচেটিয়া অধিকার তার আর কোনো দিনই থাকবে না।
যুদ্ধ মার্কিন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং অন্য সবাইকে দুর্বল করেছে। তবে ১৯৭০ সাল নাগাদ বাকি বিশ্ব নিজেদের পুনরুদ্ধার করায় বৈশ্বিক জিডিপিতে আমেরিকার হিস্যা এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে।
প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই বিষয়টিকে পতনের লক্ষণ হিসেবে দেখেছিলেন এবং সে কারণেই তিনি ডলারকে সোনার মান থেকে তুলে নিয়েছিলেন। তবে এই অর্ধশতক পরও মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার এগিয়ে আছে এবং বিশ্বব্যাপী জিডিপিতে আমেরিকার হিস্যা এখনো প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
আজকাল চীনের উত্থানকে প্রায়শই আমেরিকান পতনের প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের দিকে গভীরভাবে তাকালে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে চীনের ক্ষেত্রে একটি অগ্রগতিমূলক পরিবর্তন ঘটেছে। আপেক্ষিক দিক থেকে বিচার করলে চীনের এই পরিবর্তনকে আমেরিকান পতন হিসাবে দেখানো যেতে পারে। কিন্তু অ্যাবসলিউট বা পরম পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে বোঝা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো চীনের চেয়ে অনেক শক্তিশালী এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও তা থাকবে।
চীন মূলত একটি নজরকাড়া সমকক্ষ প্রতিযোগী। তবে চীনের উল্লেখযোগ্য দুর্বলতাও রয়েছে। ক্ষমতার সামগ্রিক ভারসাম্যের ক্ষেত্র থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ছয়টি দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা রয়েছে।
প্রথমটি হলো, ভৌগোলিক সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্র দুটি মহাসাগর এবং দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দ্বারা বেষ্টিত। অন্যদিকে, চীন ১৪টি দেশের সঙ্গে একটি সীমান্ত শেয়ার করছে। দেশটি ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আঞ্চলিক বিরোধেও জড়িত।
দ্বিতীয়টি হলো, আপেক্ষিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি শক্তিতে স্বনির্ভর; যেখানে চীন আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
তৃতীয়টি হলো, যুক্তরাষ্ট্র তার বৃহৎ আন্তর্দেশীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ডলারের আন্তর্জাতিক ভূমিকা থেকে শক্তি অর্জন করে। একটি আস্থাযোগ্য রিজার্ভ মুদ্রার অবশ্যই অবাধ রূপান্তরযোগ্যতা থাকতে হয়; সেই রিজার্ভের পুঁজিবাজার এবং আইনের শাসনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকতে হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চীনের খামতি রয়েছে।
চতুর্থটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের একটি আপেক্ষিক জনসংখ্যাগত সুবিধা রয়েছে। দেশটি বর্তমানে বিশ্ব জনসংখ্যা র্যাঙ্কিংয়ে তার স্থান (তৃতীয়) ধরে রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের ১৫টি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে সাতটিই আগামী দশকে সংকুচিত শ্রমশক্তি হিসেবে পরিণত হবে। কিন্তু মার্কিন কর্মশক্তি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর অন্যদিকে চীন শ্রমশক্তির শীর্ষে ছিল সেই ২০১৪ সালে।
পঞ্চম সুবিধাটি হলো, আমেরিকা অনেক আগে থেকেই মূল প্রযুক্তিতে (জৈব, ন্যানো, তথ্য) এগিয়ে আছে। চীন গবেষণা ও উন্নয়নে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। দেশটি এখন পেটেন্টের ক্ষেত্রে ভালো স্কোর করেছে। কিন্তু তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে নিজের গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো মার্কিন প্রতিষ্ঠানের অনেক পেছনে রয়েছে।
সর্বশেষ সুবিধা হলো, আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, সফট পাওয়ার দিয়ে বাকি বিশ্বকে আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে আমেরিকা চীনকে অনেকে পেছনে ফেলে রেখেছে। এসবের আলোকে বলা যায়, একবিংশ শতাব্দীর পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের হাত এখনো শক্তিশালী রয়েছে। কিন্তু আমেরিকানরা যদি চীনের উত্থান সম্পর্কে হিস্টিরিয়ায় ভোগে কিংবা নিজের ‘শিখর’ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার কার্ড খারাপভাবে খেলতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী জোট এবং প্রভাবসহ যেসব দামি কার্ড রয়েছে, সেগুলোকে বর্জন করা আমেরিকার জন্য মারাত্মক ভুল হবে। এটি করা হলে তা আমেরিকাকে আবার মহান করা তো দূরের কথা, বরং তা আমেরিকাকে অনেকটাই দুর্বল করে দিতে পারে। আমেরিকানরা চীনের উত্থানের চেয়ে দেশে জনতুষ্টিবাদী জাতীয়তাবাদের উত্থানকে বেশি ভয় পায়। ইউক্রেনকে সমর্থন করতে অস্বীকার করা বা ন্যাটো থেকে সরে আসার মতো জনমোহিনী নীতি মার্কিন সফট পাওয়ারের জন্য বড় ক্ষতি করবে।
নভেম্বরে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হলে এই বছরটি আমেরিকান শক্তির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। তখন দেশটি সত্যিকারের পতনের দিকে যেতে পারে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জোসেফ এস নাই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষাসচিব ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক