বাংলাদেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১ নভেম্বর–পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসা নীতি ইতিমধ্যে রাজনীতিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
এটি সরকারের জন্য নানা ধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করেছে, যা ৩ মে–পরবর্তী আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া এবং সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে এটি সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা একে সরকারের জন্য ইতিবাচক হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন।
মার্কিন ভিসা নীতিতে নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতে হবে বলা আছে, তবে এ জন্য নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে হবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। এ কারণে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে এবং নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করলে মার্কিন ভিসা নীতির শিকার হবে বরং বিএনপি। ধারণা করা যায় যে এমনভাবে একটি নির্বাচন হলে শূন্য মাঠে আওয়ামী লীগের জেতার সম্ভাবনাও বহুগুণে বাড়বে।
এই ভিসা নীতি কি আসলেই বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের জন্য বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে? নাকি এটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য এমন পরিবেশ নিশ্চিত করার চাপ তৈরি করেছে, যা অগ্রাহ্য করা দেশের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে?
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন মানেই বা কী, এটি কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বাধ্যবাধকতাও তৈরি করে? এসব বিষয় বাংলাদেশের বিবদমান বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষকে প্রজ্ঞার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। শুধু দেশের জনগণ, ভাবমূর্তি ও স্বার্থের কারণে নয়; নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনেও এটি তাদের ভাবা প্রয়োজন।
এই ভাবনার প্রয়োজনীয় রসদ বাংলাদেশের সংবিধান, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো এবং এ দেশের নির্বাচনী ইতিহাসের মধ্যে রয়েছে।
২.
বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন সুষ্ঠু বা অবাধভাবে অনুষ্ঠিত হতে হবে, তা স্পষ্টভাবে বলা নেই। কোনো দেশের সংবিধানে এভাবে এটি বলা থাকেও না। তবে এটি প্রণয়নকালে গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বারবার নির্বাচন বলতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, জনগণের অবাধ ভোটাধিকার, জনগণের প্রতিনিধির শাসন এবং ক্ষমতার সুষ্ঠু হস্তান্তরের কথা বলেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ ‘কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে’ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে ‘সাচ্চা জনপ্রতিনিধিদের’ দ্বারা দেশ শাসনের কথা বলেছেন।
বঙ্গবন্ধু অবাধ ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিদের সাদরে বরণ করার মানসিকতার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদেও গণতন্ত্র বলতে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এটি সহজেই অনুমেয় যে ব্যাপক জনসমর্থিত কোনো দলের জন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে এবং এভাবে জনগণকে ভোট দিতে অনীহ করে তুললে দেশ শাসনে জনগণের অংশ নেওয়ার সুযোগই আর থাকে না।
অন্যদিকে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি না করা হলে এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা একটা সময় পর্যন্ত ছিল না বলে নির্বাচনগুলো অংশগ্রহণমূলক ছিল। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের কারণে প্রকৃত অর্থে একটি একতরফা নির্বাচন এ দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে।
পরে বিএনপি আমলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব কটি বড় বিরোধী দলের বর্জনের মুখে আরও একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ দুটো নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ হলেও তা জনগণের বিরাট অংশের কাছে বৈধতা পায়নি। একইভাবে ২০১৪ সালের নির্বাচনও বৈধতার সংকটে দুষ্ট ছিল বলে আওয়ামী লীগ নেতারা এটিকে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করে অচিরেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বৈধ নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হিসেবে এটি অংশগ্রহণমূলক হবে, এটি ভাবা হয়। তবে অংশগ্রহণমূলক হলেই একটি নির্বাচন প্রকৃত নির্বাচন হবে, এমন কোনো কথা নেই। প্রকৃত নির্বাচনের আরও বহু শর্তের কথা গণপরিষদ বিতর্কে বলা হয়েছে। এমন শর্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দলিলেও রয়েছে।
৩.
বৈধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বহু সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে রয়েছে। যেমন মানবাধিকারসম্পর্কিত দুটো সর্বজনীন দলিলে (১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত চুক্তি) বলা আছে, দেশ শাসনের বৈধতা রয়েছে শুধু তাদের, যারা জেনুইন বা সত্যিকারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসে। শেষোক্ত চুক্তিবলে প্রতিষ্ঠিত হিউম্যান রাইটস কমিটির ব্যাখ্যা (জেনারেল কমেন্ট নম্বর ২৫) অনুসারে এমন নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সবার (দল, প্রতিযোগী, রাজনৈতিক কর্মী ও ভোটার) অংশগ্রহণের সমান সুযোগ তৈরি করা এবং তাদের সমাবেশ, সংগঠন ও বাক্স্বাধীনতার মতো ফ্রিডম রাইটস নিশ্চিত করা। নির্বাচনী সহযোগিতা–সম্পর্কিত জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিভিন্ন রিপোর্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কম্পেনডিয়াম অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ফর ইলেকশন এবং ইন্টারপার্লামেন্টারি গ্রুপের নির্বাচনী মানদণ্ডসম্পর্কিত ঘোষণায়ও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান ও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক আইনগুলোর বিবেচনা করলে তাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিষয়ে কয়েকটি সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। এক: বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থে নির্বাচন হতে হবে জেনুইন বা বিশুদ্ধ একটি নির্বাচন, যেখানে জনগণ অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাঁদের প্রকৃত জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে পারবেন।
দুই: এমন নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সব দল, প্রতিযোগী, রাজনৈতিক কর্মী ও ভোটারদের সমান সুযোগ প্রদান করা। তিন: নির্বাচনে বিজয়ীদের দেশ পরিচালনার সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আবার এমন পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য শান্তিপূর্ণ সভা, সমাবেশ, আন্দোলন করা হলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখার কোনো যুক্তি নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সৎভাবে বিবেচনা করতে হবে, এমন পরিস্থিতি নিশ্চিত করা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় আদৌ সম্ভব কি না? ১৯৯৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনগুলো বলে না, এটি আদৌ সম্ভব। বরং এগুলো এই বার্তাই দেয় যে নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না করা হলে নির্বাচনে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটে না এবং নির্বাচনে বিজয়ী দলের নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
বাংলাদেশের বর্তমান বড় চ্যালেঞ্জ তাই শুধু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা নয়, নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে যত দ্রুত সম্ভব, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের বর্তমান বড় চ্যালেঞ্জ তাই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে যত দ্রুত সম্ভব এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।
৪.
নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়, এ নিয়ে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি কম নয়। তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমাদের অনেকেই এখন এমন একটি নির্বাচনের তাগিদ বোধ করছেন দেশের জন্য অবমাননাকর একটি ভিসা নীতি ঘোষিত হওয়ার পর। মার্কিন এই ভিসা নীতিকে তাই ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে হচ্ছে দেশের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষদের।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক