গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র চীনের এমন কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যাঁরা তিব্বতের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, জাতিগত, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় পরিচয় মুছে দিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পদক্ষেপটা নিয়েছে। আরও কিছু দেশ একই পদক্ষেপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ দেশই কাপুরুষের মতো ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছে।
জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিব্বতের ১০ লাখ শিশুকে জোর করে চীনা সমাজে আত্তীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিশুদের তাদের বাড়ি ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় পরিচালনাধীন আবাসিক বিদ্যালয়ে মান্দারিন ভাষায় পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন দাবি জানিয়েছেন, চীন যেন তিব্বতিদের স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মূল করার প্রচেষ্টা থেকে সরে আসে।
ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, তারা যেন তিব্বতি শিশুদের জবরদস্তিমূলকভাবে সরকার পরিচালিত আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়ানোটা বন্ধ করে। তিব্বত এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অন্য অংশে নিপীড়নমূলক আত্তীকরণ নীতি বন্ধ যেন তারা বন্ধ করে।’ অন্য অংশ বলতে, ব্লিঙ্কেন মূলত জিনজিয়াং, ইনার মঙ্গোলিয়া ও হংকংয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এসব অঞ্চলের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার করে আসছে চীন।
১৯৫০ সালে চীন তিব্বতকে নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়। আমেরিকার একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক প্রকাশ্যে ও নীতিগত অবস্থান নিশ্চিত করেই বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করবে। যদিও প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও তাঁর কঠিন হৃদয়ের কমিউনিস্ট ক্যাডাররা নীতির ধার ধারেন না। তাঁদের কাছে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পরার্থপরতা পুরোপুরি ভিনগ্রহী একটি ধারণা।
তিব্বতিদের ওপর বাড়াবাড়ি করার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিধিবহির্ভূতভাবে আটক, নির্যাতন, যৌন অপরাধ, গুম ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বড় ধরনের শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এক অর্থে, তিব্বতে চিরস্থায়ী লকডাউন চলছে। পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিব্বত থেকে বাইরে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। বিদেশি গণমাধ্যমকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। চীন চায়, সবাই যেন তিব্বতকে ভুলে যায়।
বাইডেন প্রশাসন চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ কারণে তারা বেইজিং যেসব মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করে চলেছে, তা নিয়ে কথা বলতে ইতস্তত করছে না।
এ সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনে মধ্যম সারির, নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক দেশের সরকারগুলো সি চিন পিংয়ের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবে থাকতে পারেন যে চীন তাদের জন্য ন্যায্য একটি দুনিয়া তৈরি করবে। তারা কি নিষ্পাপ শিশু, নাকি দুর্নীতিগ্রস্ত, নাকি নিছক আহাম্মক?
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেছেন, এ সপ্তাহে তিনি তাঁর বেইজিং সফরকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ জানাবেন। ব্রিটিশ মন্ত্রীরা সব সময় সেটি বলে আসছেন। কিন্তু তাতে কিছুই বদলায় না। প্রশ্ন হলো, তাঁকে কেন চীনে যেতে হবে? আপাতভাবে মনে হতে পারে, চীনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে নিতেই এই সফর।
এটা সত্যিকার অর্থে একটি বিভ্রম। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দৈত্যাকার একটি দল। তারা গোয়েন্দাবৃত্তি, গুন্ডামি, হ্যাকিংয়ের মতো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
প্রতিবাদকারীদের পেটানো, নব্য ফ্যাসিবাদী ভ্লাদিমির পুতিনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া, হংকংয়ের সঙ্গে তাদের যে যৌথ ঘোষণা, সেটি না মানা, গণতান্ত্রিক তাইওয়ানকে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং কর্তৃত্ববাদী নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার পরিকল্পনা করছে তারা।
যুক্তরাজ্য চীন নিয়ে কি নীতি গ্রহণ করল, তা নিয়ে সি চিন পিংয়ের একবিন্দু্ও ভ্রুক্ষেপ নেই। কেননা, যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীল ব্যক্তিরা এই নীতির সঙ্গে একমত নন। বিশ্বের অনেক কটি বিপজ্জনক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মধে৵ তিব্বত একটি। আর সেখানে মানবতার বিরুদ্ধে বড় একটি অপরাধ হচ্ছে।
তিব্বতি শিশুরা যে মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটি আমাদের পক্ষে অনুমান করা কঠিন। তিব্বতের জনমিতি বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই এই নিপীড়ন করা হচ্ছে। তিব্বতিদের ওপর সংস্কৃতির আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়া এবং তিব্বতি ঘরানার বৌদ্ধধর্মের চর্চা ও তিব্বতি ভাষার কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্য থেকেই এই নিপীড়ন চলছে।
তিব্বতি শিক্ষাবিষয়ক সমাজতাত্ত্বিক গিয়েল লো বলেছেন, ‘চীন সরকার পরিবারগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে শিশুদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এই শিশুদের জোর করে তাদের নিজেদের তিব্বতি সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
এ বছর প্রকাশিত জাতিসংঘের আরেকটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন জানাচ্ছে, হাজার হাজার তিব্বতিকে তাদের বাড়িঘর থেকে এবং গ্রামীণ এলাকার কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর তাদের নিম্ন মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবে তিব্বতিদের পরিচয় মুছে ফেলা এবং তাদের প্রথাগত জীবনযাপন থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে।
তিব্বতিদের ওপর বাড়াবাড়ি করার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিধিবহির্ভূতভাবে আটক, নির্যাতন, যৌন অপরাধ, গুম ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বড় ধরনের শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এক অর্থে, তিব্বতে চিরস্থায়ী লকডাউন চলছে। পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিব্বত থেকে বাইরে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। বিদেশি গণমাধ্যমকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। চীন চায়, সবাই যেন তিব্বতকে ভুলে যায়।
ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমও সতর্ক করেছে, তিব্বতি বৌদ্ধদের ওপর চীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও দমন তীব্র হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ তিব্বতিদের ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, ধর্মীয় সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
তিব্বতিদের এই বিপর্যয় আরও তীব্র হতে পারে। তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার উত্তরাধিকারী কে হবেন তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত অজ্ঞাতনামা এক ছেলে শিশুর নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বেইজিং এখন তাদের পছন্দের প্রার্থীর জন্য জোর করছে।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চীন তিব্বতিদের মৌলিক মানবাধিকার যখন পদদলিত করছে, তখন বিশ্বজুড়ে সরকারগুলো নীরব থাকছে। সে কারণেই চীন তিব্বতকে মুছে ফেলতে পারছে। কেউই তিব্বতিদের সার্বভৌম অধিকারকে এবং নির্বাসিত তিব্বতি সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।
সাইমন টিসডল দ্য গার্ডিয়ান–এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত