আওয়ামী লীগের তিন শিক্ষামন্ত্রী সস্তা জিপিএ-কেন্দ্রিক স্কুলশিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে ভেতর থেকে ধ্বংসের আয়োজন করেন—গণহারে নম্বর দেওয়া, জিপিএ–৫–এর বাম্পার ফলন ও গণপাসের প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষা খাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়।
পাশাপাশি উদার মূল্যায়ন, সহজ প্রশ্ন, খণ্ডিত সিলেবাস, বিতর্কিত কারিকুলাম, যেনতেন শিক্ষক নিয়োগ এসবে ভূমিকা রেখেছে। মানসম্পন্ন শিক্ষক ট্রেনিংয়ের অনুপস্থিতি, ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে বরাদ্দস্বল্পতা এবং সারা দেশের এক লাখের কাছাকাছি শিক্ষকের খালি পদ শিক্ষাকে ক্লাসরুম থেকে উঠিয়ে দিয়েছে।
জাতিকে ভেতর থেকে ধ্বংসের যেসব আয়োজন করেন তাঁরা, সেগুলোর সংস্কারে দ্রুত হাত দিতে হবে। শিক্ষায় মানসম্পন্ন পরিবর্তন আনতে হলে সবার আগে চাই গভীরতর অডিট বা নিরীক্ষামূলক কার্যক্রম, বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর যাচাই-বাছাই এবং কী প্রভাব পড়েছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান। শ্রেণিশিক্ষাকে, পরীক্ষার প্রশ্নকে ও উত্তরপত্র মূল্যায়নকে যেকোনো মূল্যে মানে ফেরাতে হবে।
তবে স্কুলে কম্পিউটার প্রদানের প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখতে হবে, সেসব কম্পিউটার ও ল্যাব আদৌ সচল কি না, কোথায় সচল, কোথায় অচল, যোগ্য আইটি শিক্ষক আছেন কি না—এসবের নিয়মিত অডিটের চর্চা চালু করা দরকার। কম্পিউটার শ্রেণিশিক্ষায় ব্যবহার না করে শুধু প্রিন্টিং ও স্ক্যানিংয়ে ব্যবহার করা, কম্পিউটার প্রিন্টারের কালি কেনার দুর্নীতি থামিয়ে শ্রেণিশিক্ষাকে সফটওয়্যারভিত্তিক লার্নিংয়ের রোডম্যাপ বানাতে হবে।
পারফরম্যান্স ও গবেষণা ফোকাসহীন পদায়ন-পদোন্নতি, ঘুষনির্ভর দলীয় বদলির প্রতিটি বিষয়কে সঠিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপে ভাগ করে ডিপ স্টাডি করে করণীয় ঠিক করতে হবে।
আওয়ামী লীগ আমলের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় চেয়ারম্যান, ভিসি, প্রক্টর, প্রো–ভিসি সরিয়ে দিয়ে সৎ ও নির্দলীয় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। ইতিমধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকে পদত্যাগ করেছেন। নিয়মতান্ত্রিক এবং পারফর্মিং প্রশাসক লাগবে আমাদের। দেশের স্কুল-কলেজের অভিভাবক কমিটিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাখা নিষিদ্ধ করতে হবে। দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষকদের লাল-নীল-সাদা দলের রাজনীতি, শিক্ষা প্রশাসনের শতভাগ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়াই ভালো।
বিপরীতে শ্রমের পরিবেশ, মজুরিকাঠামোর অধিকারের জন্য শিক্ষক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সমিতিগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের ট্রেড ইউনিয়নে রূপান্তর করা যেতে পারে। ছাত্র ও শিক্ষকেরা চাইলে পার্টি অফিসে এসে রাজনীতি করবেন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বড় শিক্ষা হচ্ছে, ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবি উঠতে সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় ছাত্ররাজনীতির দরকার পড়ে না।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল নির্মাণ, রং করা, দৃষ্টিনন্দন গেট, এগুলোয় মনোযোগ না দিয়ে গুণগত টিচার্স ট্রেনিং, মানসম্পন্ন টিচিং স্টাফ, গুণগত ক্লাস লেকচার কীভাবে নিশ্চিত হবে, এটা প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আলাদা আলাদা ওয়ার্কিং গ্রুপে ভাগ করে পরিকল্পনায় আনতে হবে। বাইরের সৌন্দর্য নয়, ভেতরের শিক্ষাকে মানে ফেরাতে হবে—স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আমাদের লাগবে মানসম্পন্ন ও দক্ষতানির্ভর শিক্ষা, যে শিক্ষার বাজারচাহিদা আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই নৈতিকতাও লাগবে। তবে হ্যাঁ, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বৈরাচার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের স্মরণে সৌধ নির্মাণ করা দরকার। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মরণে বিমূর্ত সৌধ করে অধিকার আদায়ের সংগ্রামী চেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেবে।
আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ মিশনের লুটপাটের প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেসব দুর্নীতিবান্ধব এবং বেদরকারি সেগুলা বন্ধ করতে হবে, শুধু ফলদায়ক প্রকল্পগুলো থাকবে। আমাদের একটা টেকসই, কার্যকর ও সাশ্রয়ী ডিজিটাল রূপান্তরে যেতে হবে, যেখানে লুটপাট ও অনিয়ম থাকবে না। রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার খাতগুলোর দিক থেকে এটা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল রূপান্তর মাস্টারপ্ল্যান।
শিক্ষাকে ক্লাসরুমে ফেরাতে হবে। ক্লাসরুমে শিক্ষাকে ফেরানোর এ কাজ মহাযজ্ঞ। এর প্রধানতম একটা হাতিয়ার হবে ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’। ক্লাসরুমে সফটওয়্যারভিত্তিক শিক্ষা (লার্নিং সফটওয়্যার), টিচারদের ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে লার্নিং অ্যান্ড সার্টিফিকেশন সফটওয়্যার, স্কুল ও ক্লাসের প্রশাসনিক কাজের সফটওয়্যার ইত্যাদি সবকিছুর জন্য, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম বুকিং-ম্যানেজমেন্টের জন্য আমাদের অনেক সফটওয়্যার ফুটপ্রিন্ট তৈরি করতে হবে।
নিয়োগ ও বদলি–বাণিজ্য থামাতেও কর্মদক্ষতা অনুসারে নিয়োগ, সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় বসানো এবং চাহিদা অনুযায়ী নিয়োগ বা বদলিকে সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় এনে অটোমেশন করা যায়। এতে ঘুষের চক্রে বাধা দেওয়া যাবে। এমনকি কলেজগুলোয় পুরোনো কোর্স ও আসন কমিয়ে কর্মদক্ষতার জন্য যুব ট্রেনিং, বিদেশমুখী শ্রমবাজারের উপযোগী অনলাইন কোর্স, সফটওয়্যার লার্নিংকেন্দ্রিক ক্লাসরুম কোর্স খোলা যেতে পারে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেকার তৈরির কোর্সগুলো দক্ষতাভিত্তিক রূপান্তর করতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সব মাদ্রাসায় কারিগরি শিক্ষা, কম্পিউটার আইটি অফিস ওয়ার্কিং স্কিলগুলো বাধ্যমূলক করতে হবে। কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়য়ে নতুন কোর্স খোলার বিষয় নতুন ভবনের আলাপ ওঠে, অথচ বিদ্যমান ক্লাসরুমগুলোর দৈনিক ব্যবহার গড়ে চার ঘণ্টার বেশি নয়। পুরোনো ধ্যানধারণা বাদ দিয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অত্যন্ত সফল ভৌত অবকাঠামো ব্যবহারের ‘ইফিশিয়েন্ট ও অপটিমাল’ মডেলকে আমলে নিতে হবে।
ডিজিটাল রূপান্তরকরণে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা লাগবে এবং হাজার হাজার কারিগরি রিসোর্স ও বিষয়ভিত্তিক গবেষকেরা পেছন থেকে কাজ করবেন। এটা কর্মসংস্থান তৈরির নতুন খাত।
বাংলাদেশের শিক্ষা খাতসহ বিভিন্ন খাতের প্রকৃত ডিজিটাল রূপান্তরকরণে স্বল্পমধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ভিশনের আলোকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে একটা রোডম্যাপ ও মহাপরিকল্পনা তৈরি করা দরকার। এটা হতে পারে একটা আউটস্ট্যান্ডিং ওয়ার্ক।
আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ মিশনের লুটপাটের প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেসব দুর্নীতিবান্ধব এবং বেদরকারি সেগুলা বন্ধ করতে হবে, শুধু ফলদায়ক প্রকল্পগুলো থাকবে। আমাদের একটা টেকসই, কার্যকর ও সাশ্রয়ী ডিজিটাল রূপান্তরে যেতে হবে, যেখানে লুটপাট ও অনিয়ম থাকবে না। রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার খাতগুলোর দিক থেকে এটা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল রূপান্তর মাস্টারপ্ল্যান।
আমাদের শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ভাষা-গণিত-বিজ্ঞানের আধুনিক কারিকুলাম পড়ানোর মতো দক্ষ করে গড়তে তুলতে হবে। দেশে স্কুল-কলেজে গণিত-বিজ্ঞান ও ভাষা শেখানোর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষকের প্রকট অভাব আছে।
এ ক্ষেত্রে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরকরণে টিচার্স ট্রেনিং সফটওয়্যার মডিউল, ছাত্র–শিক্ষকদের জন্য লার্নিং মডিউলগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটা করা গেলে আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ভালো হবে, মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির পথ প্রশস্ত হবে, ক্লাসে প্রস্তুতির মানও ভালো হবে, শিক্ষার্থীরা ইফিশিয়েন্ট লার্নিং সিস্টেম পাবেন, শিক্ষকদের দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজ কমবে, ক্লাসরুমে সময়ে বেশি দিতে পারবেন, গবেষণাও।
অযোগ্য শিক্ষকদের কী করা হবে? এ প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সফটওয়্যার লার্নিং প্রোগ্রামে এনে স্তরে স্তরে মানোন্নয়ন করার চেষ্টা হবে, নাকি একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে শিক্ষা থেকে সরিয়ে শুধু দাপ্তরিক কাজে নিয়োগ করা হবে—এটা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকনির্দেশনার দরকার হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাকরিচ্যুতি পরিহার করে যথাসম্ভব কর্মরূপান্তরের পক্ষে। তারপরও অযোগ্য শিক্ষকদের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সর্বনাশ থামাতে হবে।
স্কুল-কলেজের সিলেবাস পুনর্মূল্যায়ন করে আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলাম দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কনটেন্ট শ্রমবাজারের দক্ষতার চাহিদার ভিত্তিতে রিমেক করতে হবে। এসব কাজ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে করতে হবে না। তাঁরা ভিশন দেবেন, ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করে দেবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে সঠিক নেতৃত্ব তৈরি করে দায়িত্ব অর্পণ বা বণ্টন করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) প্রতিটি জায়গায় বর্তমান বিশ্বের এবং দেশের শ্রমবাজারের জন্য দরকারি দক্ষতা তৈরির জন্য নতুন নতুন কোর্স চালু করতে হবে। বিদ্যমান কোর্সগুলো যেখানে দরকার, সেখানে সংস্কার আনতে হবে।
পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও আধুনিক কোর্স শুরুর অর্থায়ন, শ্রমবাজারে কম চাহিদার কোর্স রূপান্তরে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশের কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের মান্ধাতার আমলের কোর্স দেশ-বিদেশের শ্রমবাজার উপযোগী নয়, এর সুলুক সন্ধান রকেট সায়েন্স নয়। দূরে যেতে হবে না, চীন–ভারতের সঙ্গে প্রতিটি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টগুলোর কোর্স ম্যাপিং করলেই সব বেরিয়ে আসবে।
শিক্ষকদের একদিকে কমফোর্ট জোন থেকে সরিয়ে আনতে হবে, পাশাপাশি আলাদা বেতনকাঠামো দিয়ে সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এর বাইরে লাগবে আরও দুটি বিষয়—স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা প্রাইভেট টিচিং বা কোচিং করাতে পারবেন না। শিক্ষার্থী ও বেকারেরাই শুধু কর্মের জন্য প্রাইভেট টিচিং বা কোচিং দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কোচিং সেন্টারের সঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিয়োগ–জালিয়াতিকে ভেঙে দিতে এসব কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।
আওয়ামী লীগ ব্যাংক ও বাজেট লুট করেছে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা থাকলে আমরা সেসব থামাতে পারব। কিন্তু আমরা যদি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া শিক্ষাকে সংস্কার করতে না পারি, আমাদের সর্বনাশ কেউ থামাতে পারবে না।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক