একটি কাঁঠাল, ফিয়ার অব মিসিং আউট ও চারটি খুন

দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল
ছবি: সংগৃহীত

মনোবিজ্ঞানে একটি টার্ম আছে, ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’। এককথায় যাকে বলা হয়, ফোমো। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছু হারানোর ভয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা বড় রকমে জেগে ওঠে। কোনো কিছু যেভাবেই হোক, পেতেই হবে—এমন আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মানুষের নিজের মধ্যে তৈরি হয় নিয়ন্ত্রণহীনতা। মনমেজাজ হারিয়ে অসহিষ্ণুতা তৈরি হয়। আর এ অসহিষ্ণুতাই তো যত হানাহানি ও সহিংসতার কারণ। ফলে তুচ্ছ কারণেও দেখা যায় বিশাল এক রক্তক্ষয়ী ব্যাপার ঘটে গেছে।

সুনামগঞ্জে একটি কাঁঠাল নিলামকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চারজন মৃত্যুর ঘটনা এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। ঘটনার সূত্রপাতটা সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা জেনে নিই।

শান্তিগঞ্জ উপজেলায় হাসনাবাদ গ্রামের মসজিদে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর এক ব্যক্তির দান করা একটি কাঁঠাল নিলামে তোলা হয়। একজন ওই কাঁঠাল ২৫০ টাকায় কিনে নেন। পরে আরেকজন এসে এটি এক হাজার টাকা দাম দেবেন বলেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। পরে বয়োজ্যেষ্ঠ মুসল্লিরা ওই ব্যক্তিদের শান্ত করে বিদায় করে দেন। এরপরও এ নিয়ে ওই দুই ব্যক্তির পক্ষে দুই ভাগ হয়ে গ্রামের লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে জনপ্রতিনিধিরা এ বিষয়ে কোনো বিবাদে না জড়ানোর জন্য দুই পক্ষকে অনুরোধও করেন।

এ নিয়ে সোমবার সকালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে আরেক দফা সালিস বৈঠক হয়। সেখানেও এই উত্তেজনা নিরসন হয় না। সালিসের কিছুক্ষণ পরই উভয় পক্ষের লোকজন লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সেই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত চারজন নিহত হলেন।

আরও পড়ুন

একটি কাঁঠাল নিয়ে এত প্রাণহানি স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা তৈরি করেছে। অনেকে এ নিয়ে হাস্যরসও করছেন। কিন্তু বিষয়টি কোনোভাবেই হাস্যরসের নয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজ কতটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে বরং উদ্বেগই বাড়ার কথা।

ওই গ্রামে, এমনকি যাঁরা সংঘর্ষে জড়ালেন বা মারা গেলেন, তাঁদের অনেকের ঘরেই বা ভিটেমাটিতে কাঁঠালগাছ আছে। সেই গাছেও নিশ্চয়ই কাঁঠাল ধরেছে বা ধরে। কিন্তু এরপরও কেন এই কাঁঠাল নিলামকে কেন্দ্র করে চার–চারজন মানুষকে মরে যেতে হবে। এখানেই আসলে কাজ করে ফোমো। যে দুজন ওই নিলামে অংশ নেন, তাঁদের উভয়েরই কাঁঠালটি চাই। সেটি কোনোভাবে হারানো যাবে না। ফলে সেই কাঁঠাল আর ‘সামান্য’ থাকে না। সেখানে যুক্ত হয়ে যায় আত্মসম্মানবোধ বা আত্মমর্যাদা, যা পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী পর্যায়ে চলে যায়। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় পুরোনো শত্রুতা বা বিরোধ।

গ্রামের মানুষের ভেতরে যে যূথবদ্ধ চেতনা এবং পরার্থবোধ সব সময় বিরাজমান ছিল, তা ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বার্থপরতাও। সেই বোধ থেকেই আমরা দেখি, চোখে টর্চের আলো পড়াকে কেন্দ্র করে বাগ্‌বিতণ্ডা ও ছুরি মেরে হত্যার ঘটনাও। গত সপ্তাহে বাগেরহাটের কচুয়ায় এ ঘটনা ঘটে।

২.

আমরা যাঁরা শহরে থাকি, শহুরে ব্যস্তময় জীবনে বাস করি, তাঁদের মধ্যে গ্রামে ফিরে যাওয়ার একটি তাড়না কাজ করে সব সময়। যে কারণে আমরা ঈদের কয়েক দিনের বন্ধে মরিয়া হয়ে নাড়ির টানে ফিরে যাই। কিন্তু সেই গ্রামও যে পাল্টে গেছে বা যাচ্ছে, গ্রামের মানুষদের মন-মগজও বদলে গেছে, সেটি আমাদের সহজ চোখে ধরা দেয় না। গ্রামের সেই মন শীতল রাখা পরিবেশও যে বিলীন হতে বসেছে। ছায়া সুনিবিড় প্রকৃতি, হাওয়া বয়ে যাওয়া একটি নদীর পাড়—এমন সবই হারিয়ে যাচ্ছে।  

গত কয়েক দশকে গ্রাম অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। একসময়ের গ্রামনির্ভর অনেক পেশা হারিয়েও গেছে। গ্রামে এখন আর্থিক সচ্ছলতা কৃষি ছাড়া নানা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এখন গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠছে পাকা বাড়ি বা একতলা-দোতলা ভবন। মাটির ঘর বা কুটির আর দেখা যায় না বললেই চলে। সেই পাকা বাড়ি বা ভবনে যুক্ত হচ্ছে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাও। আগে যে ঘরের দুয়ার সারা দিন খোলাই থাকত, সেখানে এখন ভারী গেট লাগানো থাকে।

আরও পড়ুন

তথ্যপ্রযুক্তির কারণে বিশ্বও এখন হাতের মুঠোয়। ফলে শহুরে ভোগবাদী জীবন সেই অর্থে গ্রামেও ভালোভাবে আছর করেছে। পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থাও সেখানে শেকড় গেঁড়ে বসেছে। বিষয়টি আসলে আরও বিশদ আলোচনার।

ফলে গ্রামের মানুষের ভেতরে যে যূথবদ্ধ চেতনা এবং পরার্থবোধ সব সময় বিরাজমান ছিল, তা ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বার্থপরতাও। সেই বোধ থেকেই আমরা দেখি, চোখে টর্চের আলো পড়াকে কেন্দ্র করে বাগ্‌বিতণ্ডা ও ছুরি মেরে হত্যার ঘটনাও। গত সপ্তাহে বাগেরহাটের কচুয়ায় এ ঘটনা ঘটে।

মানুষের আচরণ বা মনমানসিকতার যে রূপান্তর আমরা দেখছি, সেখানে শহর আর গ্রামের মধ্যে পার্থক্যগুলো ধীরে ধীরে ঘুচে আসছে। এরপরও আমাদের কোথাও যাওয়া কিংবা গন্তব্যের জায়গায় গ্রামের ছবিই ভেসে আসে। গ্রামে গিয়ে বা সেখানে যেতে পারলে একটু স্বস্তিবোধ করি। কিন্তু সেই গ্রামই যদি এমন অস্বস্তির ঘরবসতি হয়ে ওঠে, তাহলে আমাদের জীবনবোধ ও চিন্তাচর্চা আরও বেশি সংকুচিত হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের ভরসার জায়গাগুলো একে একে ফিকে হয়ে আসছে—এই দুঃখবোধই এখন আমাদের মধ্যে জেগে উঠছে।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারি