মুক্তি রানী বর্মণরা কেন চিরতরে হারিয়ে যায়

মুক্তি রানী বর্মণ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম মেয়েটি গান গাইছে, সাবিনা ইয়াসমীনের বিখ্যাত সেই গান, ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তেও তুমি, ও আমার বাংলাদেশ প্রিয় জন্মভূমি।’ স্কুলের ফল প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে শাড়ি পরে কিশোরী মেয়েটি এই গান গেয়েছিল। তার এই প্রিয় জন্মভূমিতে নিহত হলো মেয়েটি। বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। দশম শ্রেণিতে পড়ত।

মেয়েটির নাম মুক্তি রানী বর্মণ। ঠিকানা প্রেমনগর, বাউসী, বারহাট্টা, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ, ৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিক, বারহাট্টা থানাধীন প্রেমনগর সাকিনস্থ কংস নদের পাড়ে পুরাতন ঈদগাহ মাঠের দক্ষিণ পার্শ্বে কাঁচা রাস্তার ওপর। মৌজা নং ৪২১ প্রেমনগর, ইউপি ০১, বাউসী—মামলার বিবরণী আমাকে পাঠিয়েছেন বারহাট্টার এক তরুণ। মামলার বিবরণীতে ঘটনাস্থল ও বর্ণনা এ রকম লেখা। ঘটনার তারিখ ৩ মে ২০২৩, ১৪.১৫ ঘটিকা।

মাঝে মাঝে ভাবি, কে সংখ্যালঘু, কে সংখ্যাগুরু, তার চেয়ে যদি আমরা ভাবতে পারতাম, আমরা সবাই এ দেশের নাগরিক এবং সবার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। তবে বাস্তবতা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী ভিন্ন। সব মানুষের অধিকার সবখানে সমান নয়। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য আছে। কেন আমাদের দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা কমতে কমতে সংখ্যাশূন্য হওয়ার পথে?

বারহাট্টার কিশোরী মেয়েটিকে গ্রামেরই এক বখাটে কুপিয়ে হত্যা করেন। বখাটে ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে। নিশ্চয় তাঁর শাস্তি হবে। প্রথম আলোর খবরে জানলাম, মুক্তি বর্মণ প্রেমনগর ছালিপুরা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। আর ওই বখাটে তাকে উত্ত্যক্ত করতেন। মেয়েটি প্রতিবাদ করত। ঘটনার দিন ৩ মে মুক্তি বর্মণ সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। প্রথম আলোর খবর থেকে জানলাম, মুক্তি এলাকায় বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের (বিএনপিএস) স্বেচ্ছাসেবী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। মুক্তি বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং প্রতিরোধসহ সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করেছে। উদীচীর সদস্য ছিল, থিয়েটার করত, গান গাইত। সব মিলিয়ে একটি সম্ভাবনাময় জীবন অকালে হারিয়ে গেল, যা মর্মান্তিক।

মুক্তি বর্মণ হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ হয়েছে। মানববন্ধন হয়েছে এলাকায়, শাহবাগে। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল। গোলাম কুদ্দুছ ভাই আমাকেও ফোন করেছিলেন, যেন আসি সমাবেশে। নাট্যকার মামুনুর রশীদকে সঙ্গে করে শহীদ মিনারে হাজির হয়েছিলাম। মামুন ভাই বলছিলেন, মেয়েটি আদিবাসী না? বললাম, সরকারের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তালিকায় বর্মণ নামটি আছে। তবে নেত্রকোনার এই বর্মণদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।

মাঝে মাঝে ভাবি, কে সংখ্যালঘু, কে সংখ্যাগুরু, তার চেয়ে যদি আমরা ভাবতে পারতাম, আমরা সবাই এ দেশের নাগরিক এবং সবার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। তবে বাস্তবতা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী ভিন্ন। সব মানুষের অধিকার সবখানে সমান নয়। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য আছে। কেন আমাদের দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা কমতে কমতে সংখ্যাশূন্য হওয়ার পথে?

একসময় এই ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা এ দেশে ছিল শতকরা ৩১ ভাগ, এখন ৯ ভাগের নিচে। ২০২২ সালের লোকগণনায় দেখা গেল সংখ্যালঘু জনসংখ্যা আরও কমেছে। কেন দেশভাগ হয়েছিল? কেন মুক্তি বর্মণ, দীপালি-শেফালি-অঞ্জলিরা চিরতরে হারিয়ে যায়? নিজে সংখ্যালঘু না হলে এই বেদনা অনুভব করা সহজ নয়।

আরও পড়ুন

একটু আশার খবর হলো, মুক্তি রানী বর্মণের পরিবারের পাশে অনেকে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা এলাকায় গেছেন। আমি ই-মেইল পেয়েছি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা বারহাট্টা যাবেন। ব্লাস্ট, একশনএইডসহ অনেকে আছেন দলে। এই সব সফর মুক্তির পরিবারকে শক্তি ও সাহস জোগাবে। আর্থিক সহায়তার কথাও চিন্তা করছে এই কমিটি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মামলা পরিচালনা করা। এই প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ এবং হয়রানিমূলক হবে।

অসীম ধৈর্য, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা এখানে জরুরি। সবার মন খারাপ হবে জেনেও আমি একটি তথ্য এখানে দিতে চাই। নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৫ সালের মে মাসে চলন্ত মাইক্রোবাসে একটি তরুণী ধর্ষিত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে কত প্রতিবাদ ও কর্মসূচি হয়েছে তখন। দীর্ঘ আট বছর মামলা চলতে চলতে সেই খবর হারিয়েই গেল। এই মেয়ের পাশে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। একজন সাক্ষী এখনো বাকি আছে। আর আসামিরা চলে গেছে জামিনে। আমি আশা করব, মুক্তির পরিবার সুষ্ঠু বিচার পাবে এবং সবাই শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবেন।

আরও পড়ুন

জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার–সম্পর্কিত জাতিসংঘের একটি ঘোষণাপত্র আছে, যা ১৯৯২ সালে সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। এই ঘোষণাপত্রের ১ ধারায় লেখা আছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয় ও অধিকারের স্বীকৃতি, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে এবং রাষ্ট্র এসব অধিকার সংরক্ষণের জন্য আইনগত ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। ভারত জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করে ১৯৯২ সালে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালে অঙ্গীকার করেছিল সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করবে। চলে গেছে পাঁচ বছর। এই কমিশন হলে তারাই এই বিষয়গুলো দেখভাল করতে পারত।

  • সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

    [email protected]