২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সর্বশেষ সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে এই বছরের আগস্টে জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ বা ৪ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন ছিল, যা এই বছরের মে মাস থেকে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখিয়েছে। এই সমীক্ষা বলছে, ৪৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে, যেখানে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার মাঝারি আয়ের পরিবারে ছিল ৯ শতাংশ এবং উচ্চ আয়ের পরিবারে ছিল ৩ শতাংশের কম।
সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ পরিবার অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ করেছে এবং ৭৪ শতাংশ পরিবার বাজার থেকে অল্প পরিমাণে এবং কম দামি খাবার কেনার কথা জানিয়েছে। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সব পরিবারের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ হ্রাস পেয়েছে। খাদ্যের উচ্চমূল্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব এবং আয়ের ক্ষতি ক্রমবর্ধমান খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
খাদ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। প্রায় ৭১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, এই বৃদ্ধি তাদের গভীর উৎকণ্ঠার কারণ এবং এটি উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করেছে। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১০টির মধ্যে ৭টির বেশি পরিবার খাদ্য কেনার জন্য ঋণে যাওয়া বা সম্পদ বিক্রি করার মতো জীবিকাভিত্তিক পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল প্রয়োগ করেছে।
ডব্লিউএফপির জরিপ থেকে উঠে আসা চিত্রটি এই বছরের মার্চ মাসে সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষার ফলাফল থেকে খুব আলাদা নয়।
সানেম নিম্ন আয়ের পরিবারের জীবনযাত্রার অবস্থার ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব পরীক্ষা করার জন্য দেশের আটটি বিভাগের ১ হাজার ৬০০টি নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি দরিদ্র পরিবার তাদের খাদ্যের খরচ কমিয়েছে (বিশেষ করে মাংস, মাছ ও ডিম) এবং নিম্নমানের খাবার বেছে নিয়েছে, যা তাদের খাদ্যনিরাপত্তার পরিস্থিতি ছয় মাস আগের তুলনায় আরও খারাপ করেছে।
সমীক্ষাটি আরও দেখিয়েছে, এই দরিদ্র পরিবারের প্রধান মোকাবিলার কৌশলগুলো ছিল খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, ঋণ গ্রহণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পোশাকের ব্যয় হ্রাস করা এবং সঞ্চয় হ্রাস করা। ৯০ শতাংশের বেশি দরিদ্র পরিবার বলেছে, তারা তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে এবং অর্ধেকের বেশি পরিবার গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যবহির্ভূত খরচ কমিয়েছে। অধিকন্তু ৭৫ ভাগ দরিদ্র পরিবার উচ্চ সুদে বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ এবং অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা তাদের ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের মাসিক মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ থেকে বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে মাসিক মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে ৮ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে উঠেছে।
কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ একটি অভূতপূর্ব মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হচ্ছে, যা ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয় হ্রাস করে, বিশেষ করে দরিদ্রদের, যাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ক্রয়ক্ষমতা অনেক কম। তাই ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে দরিদ্রদের জন্য পর্যাপ্ত এবং পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ঘটনাটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জন্য ‘এনটাইটেলমেন্ট ব্যর্থতার’ বা অধিকার ব্যর্থতার পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে। ‘এনটাইটেলমেন্ট ব্যর্থতা’ একটি ধারণা, যা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষ এবং ক্ষুধার কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য বলেছিলেন। অমর্ত্য সেনের মতে, এনটাইটেলমেন্ট ব্যর্থতা ঘটে, যখন মানুষ বৈধ উপায়ে (যেমন উৎপাদন, বাণিজ্য বা হস্তান্তরের মাধ্যমে) খাদ্য অর্জনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
এনটাইটেলমেন্ট ব্যর্থতা তখনো ঘটতে পারে, যখন দেশের বাজারে সামগ্রিকভাবে খাদ্যের কোনো ঘাটতি থাকে না, কিন্তু খাদ্যের বণ্টন বা বিনিময়ে অবস্থার পরিবর্তন হয়। মূল্যস্ফীতি, বাজারে কারসাজি এবং মজুতকরণে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, যা অনেক দরিদ্র মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনা কঠিন করে তুলতে পারে। এনটাইটেলমেন্ট ব্যর্থতা সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেও হতে পারে।
খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা শুধু খাদ্যের অভাবের কারণে হয়—এই প্রচলিত ধারণাকে এনটাইটেলমেন্ট ব্যর্থতার ধারণাটি শুধু চ্যালেঞ্জই করে না, বরং প্রচলিত ধারণার বিপরীতে এই ধারণা খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং ন্যায়বিচারের গুরুত্ব তুলে ধরে। বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় বিভিন্ন অংশীজনের সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।
প্রথমত, খাদ্যশস্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি, সময়মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য আমদানি এবং বিকল্প আমদানির উৎস খুঁজে বের করার মাধ্যমে বাজারে খাদ্যসামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।
দ্বিতীয়ত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করা দরকার। ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যসামগ্রী বিতরণের পরিমাণ এবং ব্যাপ্তি বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া সব দরিদ্র মানুষকে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা দরকার।
তৃতীয়ত, বাজার নজরদারির ব্যবস্থা উন্নত করা দরকার। কারণ, অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে খুবই দুর্বল। এর ফলে প্রায়ই যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বাজারে খাদ্যের দাম বাড়ে।
চতুর্থত, দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি করা এবং সরকারি পরিষেবাগুলোয় দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করাও জরুরি।
পঞ্চমত, টেকসই ও আধুনিক কৃষিপদ্ধতির প্রসার ঘটাতে হবে, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, ফসলের বৈচিত্র্য আনে, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয় এবং ফসল কাটার পরে ক্ষতি কমায়।
ষষ্ঠত, জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টিসচেতনতার উন্নতি করতে হবে, যাতে সুষম খাদ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সামগ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে বাংলাদেশ কেবল তার খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতিরই উন্নতি করবে না, বরং বৃহত্তর উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে এগিয়ে যাবে।
ড. সেলিম রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক