নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিৎজ ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশটির অর্থনৈতিক উত্থান এবং একটি প্রাণবন্ত বহুজাতিক সমাজ গঠনকে ‘অলৌকিক ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু এর পরের ১৫ বছরে বড় ধরনের দুর্নীতি ও বিদেশি কর্মী শোষণের ঘটনা দেশটির আন্তর্জাতিক সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে তা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকেও উসকে দিয়েছে।
তবে দেশটির ভাগ্য হয়তো ঘুরে যাবে। গত বছরের শেষের দিকে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিয়ে আসা নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তাঁর কার্যকর ও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্বের রেকর্ড জনমনে এ আশা জাগ্রত করে যে মালয়েশিয়া আবার স্থিতিশীল উন্নয়নের পথে ফিরে আসতে পারবে এবং দেশটিকে বৃহত্তর সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে।
১৯৯০-এর দশকে আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় তিনি দুই অঙ্কের জিডিপি প্রবৃদ্ধির তত্ত্বাবধান করেছিলেন; যা মালয়েশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম ‘ব্যাঘ্রশাবক’ হিসেবে মাথা তুলতে সহায়তা করেছিল। যখন এশিয়ায় প্রচণ্ড মন্দাভাব দেখা দিয়েছিল, তখন তিনি মালয়েশিয়ায় সংকটের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই কঠিন পরিস্থিতি সামলানোর সময় তিনি কোনো আর্থিক অপকর্মে জড়াননি।
কিন্তু পরে যখন অর্থমন্ত্রী হিসেবে নাজিব রাজাক এলেন, তখন চিত্র একেবারে উল্টে গেল। নাজিব সরকার প্রধান হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় তহবিল ওয়ানএমডিবির কোটি কোটি ডলার লুটের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। লুট হওয়া তহবিলের বেশির ভাগই নাজিবের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছিল।
দুর্নীতির দায়ে তিনি এখন ১২ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। আনোয়ার ইব্রাহিম নিজেও প্রায় এক দশক জেলে ছিলেন। তবে নাজিবের সঙ্গে তাঁর পার্থক্যটি হলো, আনোয়ারকে জেলে পাঠানো হয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি মুছে দেওয়ার জন্য।
মালয়েশিয়ার রপ্তানি খাত ইতিমধ্যে তীব্র শ্রমিকসংকটে ভুগছে। যতক্ষণ না মালয়েশিয়া সরকার শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত করে একটি স্থির শ্রমিক সরবরাহ নিশ্চিত না করছে, ততক্ষণ স্থানীয় ব্যবসা বাড়বে না এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ফিরে আসবে না। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করাই আনোয়ার ইব্রাহিমের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এটি সর্বজনবিদিত যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে রাজনৈতিক বনিবনা না হওয়ার জন্য তাঁকে সরিয়ে দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো ৭৫ বছর বয়সী আনোয়ার কি তাঁর সেই আগেকার বুদ্ধিমত্তা দেখাতে পারবেন। মালয়েশিয়া আজ যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করছে, বিশেষ করে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া এই সময়ে মহামারি–পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ধারাকে টিকিয়ে রাখায় তিনি কি আগের মতো চমক দেখাতে পারবেন?
সেই চমক দেখাতে হলে, অর্থাৎ মালয়েশিয়ার আর্থিক অবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে এবং ঋণের বোঝা কমানোসহ কঠিন পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে। এ লক্ষ্যে সামাজিক খাতের ব্যয় সংস্কার করতে হবে। মালয়েশিয়ার একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী প্রয়োজন। কিন্তু এ খাতে অর্থায়নের জন্য সরকারকে ভর্তুকি যৌক্তিক মাত্রায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে পরিষেবাগুলো ভালোভাবে লক্ষ্যপূরণ করতে পারছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। এবং অবশ্যই রাজস্ব ফাঁকি কমাতে হবে।
বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে মালয়েশিয়াকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে দেশটির কলঙ্কিত আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে শুদ্ধ করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য প্রদেয় যেকোনো প্রণোদনা উচ্চতর শ্রম মান এবং ব্যবসায়িক অনুশীলনকে মাথায় রেখে ঠিক করতে হবে। সেই প্রণোদনা দেওয়ার প্রতিটি ধাপে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।
অধিকতর বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি আনোয়ারের সরকারকে অবশ্যই মালয়েশিয়ার মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ক্ষমতাকে পরিচর্যা করতে হবে। দেশীয় কোম্পানিগুলোকে বৈশ্বিক মানের শিল্প প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে পারলে সামগ্রিক অর্থনীতি উপকৃত হবে। এর বাইরে আনোয়ারকে অবশ্যই আমলা, রাজনীতিবিদ এবং জনশক্তি-শিল্পের স্বার্থে জড়িত ব্যক্তিদের ‘লৌহ ত্রিভুজ’ ভেঙে ফেলতে হবে।
কারণ, চক্রটি মালয়েশিয়ার অভিবাসী শ্রমবাজারকে অপব্যবহার করে, অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণ করে এবং শ্রমিক ঘাটতিতে ভূমিকা রাখে। মালয়েশিয়ার রপ্তানি খাত ইতিমধ্যে তীব্র শ্রমিকসংকটে ভুগছে। যতক্ষণ না মালয়েশিয়া সরকার শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত করে একটি স্থির শ্রমিক সরবরাহ নিশ্চিত না করছে, ততক্ষণ স্থানীয় ব্যবসা বাড়বে না এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ফিরে আসবে না। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করাই আনোয়ার ইব্রাহিমের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ মোনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক এবং
অ্যান্ড্রু কাম জিয়া ই ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব মালয়েশিয়ান অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন অধ্যাপক