সিরিয়ার সংকটে তিনটি প্রধান বিদেশি পক্ষ বিদ্রোহের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিল। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সরাসরি সংলাপ পুনরায় শুরু করার আহ্বানও জানিয়েছিল। তাদের ভাষায়, দেশটির নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য ‘সন্ত্রাসীদের’ ব্যবহার করা ‘গ্রহণযোগ্য নয়’।
কাতারের দোহা ফোরামের শেষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ার বিরোধীদের যুদ্ধ বন্ধ করে সিরিয়াকে একটি ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছিল।
রাশিয়ার কূটনীতিকেরা যখন দামেস্ক ছেড়ে চলে গেলেন, তখন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছিলেন, রাশিয়া ‘সন্ত্রাসীদের বিজয় ঠেকাতে সম্ভাব্য সবকিছু করছে, যদিও তারা দাবি করে যে তারা সন্ত্রাসী নয়।’ এর আগে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন আসাদকে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য নতুন প্রচেষ্টা নিতে। তুরস্ক দাবি করে যে আসাদ উত্তর সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীকে তুরস্কের অভ্যন্তরে আক্রমণের জন্য ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। রাশিয়া এই বিষয় নিয়েও আসাদকে বিবেচনা করতে বলেছিল।
এ বছরের শুরুতে আসাদ ঘোষণা করেছিলেন, যতক্ষণ তুরস্কের সেনারা সিরিয়ায় থাকবে, তিনি তুরস্কের সঙ্গে কোনো আলোচনা করবেন না। এরপরই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত মাসে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আলেপ্পো ও হোমস শহরে আক্রমণের জন্য পরোক্ষ সম্মতি দেন।
ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এইচটিএসের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছে। এতে লাভ কী? লাভ হবে এই যে এর ফলে সিরিয়ার মাধ্যমে লেবাননে ইরানের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা যাবে।
কিন্তু তুরস্ক কি এইচটিএসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। লাভরভ বারবার উল্লেখ করেছেন, এইচটিএস জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এরা কি আসলেই আল-কায়েদার শিকড় থেকে সরে এসেছে? শেষে বলেছেন, ‘প্রমাণের জন্য ফলাফলের দিকে নজর দিতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের নাম না নিয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন, বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ‘রাশিয়ার সব প্রচেষ্টা ভেস্তে দেওয়া’। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হলে সিরিয়ায় ২০০৩ সালের ইরাক ও ২০১১ সালের লিবিয়ার মতো বিশৃঙ্খলার পুনরাবৃত্তি দেখা দেবে।
মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দ্রুত অগ্রগতিতে সতর্ক ছিলেন। প্রথমে তাঁরা আশা করেছিলেন, আসাদ এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে থাকবেন। তবে সামরিক পরিস্থিতি এত দ্রুত পাল্টে গেছে যে কূটনীতিকেরা বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন।
যখন বিরোধী বাহিনী তীব্র বেগে এগোনো শুরু করল, তখন দোহা ফোরামে উপস্থিত সিরিয়ার নাগরিক সমাজ আসাদ ও তাঁর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও ভেঙে ফেলে সব পক্ষের প্রতিনিধি নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার দাবি জানিয়েছিল, যা জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু এ দাবি আসাদ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
২০১৭ সালে আস্তানা প্রক্রিয়ার (সিরিয়ার সংকট সমাধানের জন্য তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের শুরু করা একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ) মাধ্যমে সিরিয়ার শান্তি আলোচনা হয়েছিল। ফলে চালকের আসনে এসেছিল তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরান। এই দেশগুলো ২১টি বৈঠক করে। কিন্তু এর ফলাফল ছিল রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং বিভক্ত দেশ। সিরিয়ার বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের কারণে সংঘাত থামেনি।
দোহা সম্মেলনে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রত্যাশা কম ছিল। কারণ, তুরস্কের চাওয়া—বিদ্রোহী, ইসলামপন্থী ও তুরস্কপন্থী গোষ্ঠীগুলো দামেস্কের দিকে অগ্রসর হোক। অন্যদিকে ইরান ও রাশিয়া মনে করে এইচটিএস সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
দোহা সম্মেলনের আগে এক কূটনৈতিক বৈঠক হয়েছিল। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তুরস্ককে বোঝাতে ব্যর্থ হন যে তুরস্ক ক্ষমতার এক বিপজ্জনক শূন্যতা তৈরি করছে। এই শূন্যতা পূরণ করবে সন্ত্রাসীরা।
ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এইচটিএসের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছে। এতে লাভ কী? লাভ হবে এই যে এর ফলে সিরিয়ার মাধ্যমে লেবাননে ইরানের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা যাবে। আরাঘচি বলেন, ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে গিয়ে কোনো বিভাজন থাকা উচিত নয়। আমাদের কাছে ভালো সন্ত্রাসী বা খারাপ সন্ত্রাসী বলে কিছু নেই।’
সত্যিই কি এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির ওপর এরদোয়ানের উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে? এটা এখনো পরিষ্কার নয়। আর এইচটিএসের সাম্প্রতিক যে কিছুটা উদার রূপান্তর, তা কি প্রকৃত কোনো রূপান্তর? তা–ও সময় বলে দেবে।
প্যাট্রিক উইনটুর, গার্ডিয়ানের ডিপ্লোমেটিক এডিটর
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত