যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত শুক্রবার সন্ধ্যায় গাজায় যুদ্ধ থামাতে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আসলে নিজেকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) বাধ্য করতে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকেও তা করতে হবে। বাইডেন যখন এ সময় যুদ্ধবিরতি ও ইসরায়েলি জিম্মিদের রক্ষার সবচেয়ে ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন সেটার প্রতি নেতিবাচক সাড়া দেওয়ার মানে হলো, একটি যুদ্ধাপরাধ ঘটানো।
শুধু তা–ই নয়, বাইডেনকে ‘না’ বলার মানে হলো, আরও বেশি অর্থহীন ও ব্যাপক রক্তপাত ঘটানোকে ‘হ্যাঁ’ বলা। এই রক্তপাত ইসরায়েলি সেনাদের, তার চেয়ে অনেক বেশি গাজাবাসীদের। এই ‘হ্যাঁ’ বলার মানে হলো, হামাসের হাতে জিম্মি হয়ে থাকা আটক ব্যক্তিদের মৃত্যু। এই ‘হ্যাঁ’ অর্থ গণহত্যাকে ‘হ্যাঁ’ বলা; উত্তর দিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে ‘হ্যাঁ’ বলা; ইসরায়েলকে একটি অচ্ছুত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার প্রতি ‘হ্যাঁ’ বলা।
বাইডেনকে ‘না’ বলে নেতানিয়াহু আসলে উল্লিখিত সবকিছুর প্রতি ‘হ্যাঁ’ বলেছেন। আর যিনি এ রকমভাবে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারেন, তাঁকে অবশ্যই নিজ দেশেই যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করা উচিত যদি না আমরা সব ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধী হই।
শুক্রবার ও শনিবার রাতের মধ্যকার সময়ে অনেকেই হয়তো একটা ঘোরে ছিলেন যে নেতানিয়াহু বাইডেনের প্রস্তাবে সম্মত হবেন আর তা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব, যা দৃশ্যত নেতানিয়াহুকেই দেওয়া হয়েছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্কের বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটি বিচক্ষণ কূটনৈতিক পরিকল্পনা। এর আগে এর চেয়ে ভালো আর কোনো পরিকল্পনা মেলেনি। এটা ইসরায়েলকে যুদ্ধ ত্যাগ করা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর শেষ সুযোগ উন্মোচন করে দিয়েছে।
কিন্তু প্রতি শনিবার যখন শেষ হয়, তখন যুদ্ধবাজরা সব তাঁদের সাব্বাত (ইহুদিদের সাপ্তাহিক বিশ্রামের দিন যা প্রার্থনার মাধ্যমে পালিত হয়) থেকে জেগে ওঠেন। বাইডেন তো শুক্রবার সন্ধ্যা বেছে নিয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ইসরায়েলিদের কাছে তাঁর পরিকল্পনা তুলে ধরার জন্য, যা আমাদের জন্য একটি আশার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিল। তবে তা দ্রুতই হাওয়া হয়ে যায় যখন ইসরায়েলের আকাশে শনিবার সন্ধ্যার তিনটি তারা ফুটে উঠে সাব্বাতের সমাপ্তি জানান দেয়। একই সঙ্গে জানান দেয় যে যুদ্ধ চলবে।
বাইডেন ভালো চেয়েছেন। তবে ইসরায়েলের তো অসাধু মতলব আছে। বাইডেন শান্তি চান, কিন্তু ইসরায়েল চায় যুদ্ধ। এমনকি হামাসও এখন ইসরায়েলের চেয়ে বেশি করে শান্তি চায়।
বাইডেন এই সবকিছু শেষ করতে চেয়েছেন। তিনি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন। তিনি চাচ্ছেন, কিন্তু তিনি একটা কিছু করছেন না। শুক্রবার যখন তিনি তাঁর পরিকল্পনা পেশ করলেন, তখন একটা কঠোর বাক্য যোগ করা উচিত ছিল: যদি ইসরায়েল এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করবে। এটা এক্ষুনি করতে হবে। কেবল তাহলেই এই দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি হবে, শেষ হবে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির, যা শেষ হওয়ার আপাতত কোনো লক্ষণ নেই।
যুদ্ধের এই গোটা সময় আমি এটা বিশ্বাস করিনি যে নেতানিয়াহু শুধু তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক পরিণতির বিবেচনা দ্বারা চালিত হয়েছেন। যে নেতানিয়াহুকে আমি চিনি, তাতে আমি বিশ্বাস করি যে তাঁর আরও কিছু বিবেচনা আছে। বাইডেনকে ‘না’ বলার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর মধ্যে রাষ্ট্রনায়কসুলভ যেটুকু বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট আছে, তা–ও মুছে ফেলছেন। অবশ্য আদৌ যদি সে রকম কিছু সত্যি অবশিষ্ট থেকে থাকে।
আর সেটি হলো, সামান্য হলেও সংযত হওয়ার ছাপ। আমরা তো বছরের পর বছর বিশ্বাস করে এসেছি যে যখন সেনাবাহিনী পাঠানো হয় ও যুদ্ধ সূচিত হয়, তখন এ কাজে নেতানিয়াহুই ইসরায়েলের সবচেয়ে সতর্ক ও পরিমিত প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু গত বছরের ৭ অক্টোবরের যুদ্ধ শুরু থেকে এই বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাঁর প্রতি এই ধারণার চিরতরে অবসান ঘটাবে। আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নেতানিয়াহু এবং তাঁর সহযোগী ও ডানপন্থী জবরদস্তিকারীদের উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দেহকে স্ফীত করে তুলবে। তাঁরা তো সবাই গণহত্যা চান। তাঁদের প্রতিশোধপরায়ণতা ও রক্তলোলুপতাকে আর অন্য কোনোভাবে বর্ণনা করার উপায় নেই।
তা ছাড়া তাঁদের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য কারও অপেক্ষা করার দরকার নেই। শনিবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বেইত হানায়ুনে লিফলেট ছেড়ে বিধ্বস্ত ঘরবাড়িতে ফিরে আসা উদ্বাস্তুদের আবার তা খালি করে দিতে বলেছে। আর এটাই তো প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দেওয়া যুদ্ধ শেষ করার পরিকল্পনার প্রতি ইসরায়েলের সত্যিকারের জবাব। এ ঘটনা এটাও বুঝিয়ে দেয় যে এখন থেকে যুদ্ধ কোন দিকে ধাবিত হবে। এটি ধাবিত হবে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের সীমাহীন এক চক্রে। রাফার পর আমরা আবার ফিরে যাব শুরুতে, গাজার উপত্যকার উত্তরে—মনোপলি (বোর্ডগেম) খেলার মতো করে। তবে তা নৃশংসতার সঙ্গে এবং সেখান থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে আবার রাফায়, জাবালিয়ার ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে। এভাবেই চলতে থাকবে রক্তভেজা কাদামাটিতে।
সেনাবাহিনীর ছাপাখানা লিফলেট ছাপানো বন্ধ করবে না। উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিরা কসাইখানার পশুর মতো এপাশ থেকে ওপাশে ছুটবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না গাজার শেষ পাথরটি উপড়ে ফেলা হবে। অথবা কবি মোশে তাবেনকিনের ভাষায়—‘আগুনের জন্য পরিত্যক্ত কাঠ/অথবা চুল্লির জন্য কয়লা/রুটি, আগুন ও পানি ছাড়া একটি জায়গা/যেখানে আছে শুধু কয়েক মুঠো ছাই।’
বাইডেন এই সবকিছু শেষ করতে চেয়েছেন। তিনি অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন। তিনি চাচ্ছেন, কিন্তু তিনি একটা কিছু করছেন না। শুক্রবার যখন তিনি তাঁর পরিকল্পনা পেশ করলেন, তখন একটা কঠোর বাক্য যোগ করা উচিত ছিল: যদি ইসরায়েল এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করবে। এটা এক্ষুনি করতে হবে। কেবল তাহলেই এই দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি হবে, শেষ হবে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির, যা শেষ হওয়ার আপাতত কোনো লক্ষণ নেই।
গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক। হারেৎজে প্রকাশিত তাঁর লেখাটির বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া