বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারে গোলাগুলি চলছে। এরই মধ্যে ওই সীমান্ত এলাকায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে একজন নিহত হয়েছে। সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
অকস্মাৎ এমন পরিস্থিতির কারণে সেখানকার বসবাসরত পাহাড়ি এবং বাঙালি বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশের তমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় এটিই এখন পরিস্থিতি।
৪ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে পড়েছিল, যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বাইরে। মিয়ানমারের এমন আচরণের যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চারবার মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানালেও তারা বিষয়টা খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েছে বলে মনে হয় না। বরং মিয়ানমার প্রত্যুত্তরে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
মিয়ানমার উল্টো বাংলাদেশকে দোষারোপ করে যে বক্তব্য দিয়েছে, তাকে কোনোভাবেই যৌক্তিক বলা যায় না। কয়েক দিন আগে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিমকে সে দেশের সামরিক সরকার যে বার্তা দিয়েছে, তাতে সীমান্তে এসব গোলাগুলির জন্য সে দেশের সশস্ত্র বাহিনী তাতমাদার সৈন্যদের সঙ্গে রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) ও তার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কথিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরসা’কে দোষারোপ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে এদের প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে দোষারোপ করা হয়েছে, যা ধোপে টেকে না। যদি আরাকান আর্মি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলাগুলি করে, তাহলে কাদের হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে? আরসার সঙ্গে এএর কোনো যোগাযোগ রক্ষা করার যৌক্তিকতা নেই। কারণ, রোহিঙ্গাদের কথিত সংগঠন আরসা সংগঠিত হওয়ার আগে ২০০৯ সাল থেকে, এএ সমগ্র আরাকানের (রাখাইন অঞ্চল) স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।
পরিশেষে বলতে হয়, মিয়ানমারে দুই পক্ষের মধ্যে এ লড়াইয়ে সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলের সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিকদের সুরক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। যুদ্ধ বা কোনো সামরিক ব্যবস্থা নয়, কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মিয়ানমারকে বাংলাদেশের সীমান্তে আতঙ্ক ছড়াতে বন্ধ করতে বা আন্তর্জাতিক সীমান্ত অঞ্চলে অভিযানের আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করতে বাধ্য করতে হবে।
এ কথা সত্য যে আরাকান আর্মির সৈন্য সামর্থ্য বেড়েছে, সংখ্যায় তারা এখন ৩০ হাজারের ওপরে। তাতে তারা আরাকানের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমার জান্তা সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গেরিলাযুদ্ধের পর্যায়ে রয়েছে এখন। প্রথম ধাপে এএ উত্তর রাখাইনে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সীমান্তে ও চীন রাজ্যের সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলসহ একসময়কার স্বাধীন আরাকান রাজ্যের রাজধানী ‘ম্রাউকউ’তে যুদ্ধরত।
এরই মধ্যে বেশ কিছু অঞ্চল যেমন মংডু শহরের উত্তরে ‘কপার বাজার’ নামের একটি সেনা স্থাপনা দখল করে প্রায় ৩০ জন সৈন্যকে হত্যা করার দাবি করেছে তারা। একই সঙ্গে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তসংলগ্ন পিলার নম্বর ৩৪ থেকে ৪০-এর অঞ্চল দখল এবং এ অঞ্চলে মিয়ানমারের আধা সামরিক বাহিনীর চৌকি দখল করেছে। এসব অঞ্চল পুনর্দখলের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রতিহামলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শুধু এই অঞ্চলেই নয়, চীন রাজ্যের দক্ষিণে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে পালেতোয়া অঞ্চলে মিয়ানমার বাহিনীর কাছ থেকে উচ্চ ভূমি ছিনিয়ে নিয়েছে এএ। সব অঞ্চল পুনর্দখলের জন্য মিয়ানমার বাহিনী আর্টিলারি (গোলন্দাজ বাহিনী) ব্যবহারসহ হেলিকপ্টার গানশিপ এমনকি যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করেছে, যা করেছিল বাংলাদেশ সীমান্তে। উল্লেখ্য, এই অঞ্চল ভারতের কালাদান প্রকল্পের আওতায় এবং এএ এই এলাকা তাদের অবস্থান মজবুত করতে চায়। এখানে এএর প্রধান ঘাঁটি এবং সরবরাহ রাস্তা হিসেবে বেশ উপযোগী। অঞ্চলটি দুর্গমও বটে।
এরই মধ্যে এএর রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) মুখপাত্র বাংলাদেশে গোলাগুলি এবং হতাহতের ঘটনার বিবরণ দিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে ১৬ সেপ্টেম্বরের গোলাগুলিতে নিহত ব্যক্তির নাম ও জায়গা উল্লেখ করেছে তারা। বিবৃতিতে ঘটনার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব সরকারি বাহিনীর ওপর দিয়ে বলা হয়েছে যে সামরিক জান্তা গণহত্যার মাধ্যমে আরাকানের মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছে, তারই প্রেক্ষাপটে আরাকানে চলমান লড়াইয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ ওপরও অত্যাচার চলছে।
ইদানীং এএ এবং ইউএলএ রোহিঙ্গাদের আরাকান মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। সেটি এ বিবৃতিতেও প্রকাশ পায়। ইউএলএর বক্তব্য, আরাকান মুসলমানদের উৎখাত ও তাদের ওপর অত্যাচারের কথা স্বীকার করে এর দায় মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর ওপর পরিষ্কারভাবে চাপিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, প্রায় দুই বছরের তৎপরতায় এএ তাদের সেনাসংখ্যা, প্রশিক্ষণ বাড়িয়েছে এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্রে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় তারা। যার কারণে মিয়ানমার এখন তাদের প্রতিরোধে বিমানবাহিনী নামাতে কুণ্ঠিত নয়।
এর ফলে বাংলাদেশের সীমান্তে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করতে গিয়ে কয়েকবার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। শুধু রাখাইনেই নয়; চীন, কারেন, তোয়াং ও কাচিন অঞ্চলেও জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের প্রচণ্ড লড়াই চলছে। যাতে মনে হয় মিয়ানমার জান্তা অচিরেই গৃহযুদ্ধে পতিত হতে যাচ্ছে।
যাহোক, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাখাইন বা আরাকানে এএ বা এর রাজনৈতিক ফ্রন্ট ইউএলএ ক্রমেই শক্ত অবস্থান তৈরি করছে। সেটিরই প্রতিফলন ঘটেছে, এএর রাজনৈতিক ফ্রন্টের মুখপাত্র কিয়াও সান লেইং-এর এক টুইট বার্তায়, ১৮ সেপ্টেম্বরের প্রেস কনফারেন্সের বরাত দিয়ে বলেছেন যে চলমান রোহিঙ্গা (যদিও এ শব্দ উচ্চারণ করেননি), সংকটের সমাধানকল্পে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে ইউএলএকে মুখ্য পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
তার অর্থ যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান বা রাখাইনে ইউএলএকে পক্ষ হিসেবে আলোচনায় রাখতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে এএ ও ইউএলএ রোহিঙ্গাদের আরাকান মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বা গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
পরিশেষে বলতে হয়, মিয়ানমারে দুই পক্ষের মধ্যে এ লড়াইয়ে সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলের সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিকদের সুরক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। যুদ্ধ বা কোনো সামরিক ব্যবস্থা নয়, কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মিয়ানমারকে বাংলাদেশের সীমান্তে আতঙ্ক ছড়াতে বন্ধ করতে বা আন্তর্জাতিক সীমান্ত অঞ্চলে অভিযানের আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করতে বাধ্য করতে হবে।
অপর দিকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আমাদের সীমান্ত রক্ষা ও নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য যেকোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে বর্তাবে। তবে সেখানে যেকোনো সামরিক সংঘর্ষ এ অঞ্চলকে যে অস্থিতিশীল করবে, তাতে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সব সমস্যার সমাধান আশা করি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে আরও দীর্ঘ জটিলতা সৃষ্টি হোক, সেটি আমরা চাই না।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)