পুরোনো পেনশন ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ব্যাপারে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার আগামী ১ জুলাই থেকে যে প্রত্যয় স্কিম চালু করতে যাচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট মহল থেকে সার্বিকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি প্রত্যয় স্কিমের ব্যাপারে তাদের বিরোধিতার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারকে জানিয়েছে।
তাদের আশঙ্কা, এই স্কিম চালু হলে দেশের স্বশাসিত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরগ্রহণকারী কর্মীদের অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা অনেকখানি কমে যাবে। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে মেধাবীরা ভবিষ্যতে অনাগ্রহী হবেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
প্রথমত, প্রত্যয় স্কিমের আওতায় অবসরভোগীরা যে পরিমাণ অর্থ প্রতি মাসে পাবেন, তা নির্দিষ্ট নয়—এর হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে। অন্যদিকে বর্তমান পেনশন বিধি অনুযায়ী, প্রতিবছর অবসরভোগীদের প্রদেয় অর্থ শতকরা পাঁচ ভাগ বৃদ্ধি পাবে (যা এই আইন কার্যকর হলে শুধু সরকারি কর্মচারীরা পাবেন)।
প্রত্যয় স্কিমটি নামে সর্বজনীন হলেও আদতে সর্বজনীন নয়। সরকারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে একে সর্বজনীন বলার সুযোগ নেই
বর্তমানে প্রচলিত অবসর ভাতাকে প্রতিবছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করার এই পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমের আওতায় স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য তা বাদ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যয় স্কিমে অবসরজনিত সুবিধা বা আনুতোষিক কিংবা কর্মীদের অর্জিত কিন্তু অভোগকৃত ছুটির নগদায়ন সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, বর্তমানে পাঁচ বছর চাকরি করলেই একজন কর্মীর পরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত হারে মাসিক পেনশন প্রাপ্য হন; অথচ প্রত্যয় স্কিমের আওতায় চাকরির সময় ১০ বছরের কম হলে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা শুধু জমাকৃত অর্থ ও এর মুনাফা একবারে প্রাপ্য হবেন। এতে এসব কর্মীর পরিবারগুলোর যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না। অথচ বৈষম্যমূলকভাবে শুধু সরকারি কর্মচারীদের পরিবারই আগের নিয়মে পেনশন প্রাপ্য হবেন।
চতুর্থত, বর্তমান পেনশন ব্যবস্থাপনায় পারিবারিক পেনশন থাকার কারণে অবসরভোগীর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী বা স্বামী কিংবা প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পাবেন। এমনকি তাঁর অবিবাহিত কন্যারাও এর কিছু সুবিধা পাবেন। এর সঙ্গে মূল অবসরভোগীর বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ প্রত্যয় স্কিমে অবসরভোগী কর্মী ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য আর কোনো সুবিধা পাবেন না।
পঞ্চমত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন নিয়োগ সম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকেরা যখন ১ জুলাই ২০২৪ তারিখের পর একই বা অন্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর পদে নতুনভাবে যোগ দেবেন, তাঁরা কি প্রত্যয় স্কিমের অধীনে যাবেন?
ইতিমধ্যে পেনশন কর্তৃপক্ষ থেকে জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন ব্যক্তি যদি ৩০ বছর চাকরিকালে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা করে চাঁদা দেন, আর তিনি যদি ৬০ বছর বয়সে অবসর নিয়ে ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তিনি তাঁর জমাকৃত অর্থের ১২ দশমিক ৪৭ গুণ ফেরত পাবেন। প্রত্যয় স্কিমের বিজ্ঞাপন হিসেবে এটি দারুণ! কিন্তু এ ক্ষেত্রে কি অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী তিন-চার দশকের মূল্যস্ফীতি কিংবা অর্থের সময় মূল্য (টাইম ভ্যালু অব মানি) বিবেচনা করা হয়েছে?
শিক্ষা ও গবেষণা খাতের অংশীজনেরা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন, প্রত্যয় স্কিম চালু হলে মেধাবীরা উল্লিখিত কারণে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করতে অপেক্ষাকৃত কম আগ্রহী হবেন। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতে মেধাসংকটে ভুগতে পারে। এমন আশঙ্কা থেকেই বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা প্রত্যয় স্কিমের বিরোধিতা করে আসছেন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে জারি করা সর্বজনীন পেনশন আইন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার যে রূপরেখা হাজির করেছিল, তাতেও শুধু প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা—চারটি স্কিমের উল্লেখ ছিল। প্রত্যয়ের কোনো উল্লেখ ছিল না।
প্রত্যয় স্কিমটি নামে সর্বজনীন হলেও আদতে সর্বজনীন নয়। সরকারের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান—সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকে এই প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে একে সর্বজনীন বলার সুযোগ নেই। স্কিমটি যদি সত্যিই সর্বজনীন হয়ে থাকে তবে তাহলে একে অধিকতর সর্বজনীন করার জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকেও এর আওতায় আনা হোক। তা না হলে তড়িঘড়ি করে জারি করা এই অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক স্কিম অবিলম্বে বাতিল করা হোক।
● মামুন আল মোস্তফা সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
● আবু হোসেন মুহম্মদ আহসান সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়