১৬ সেপ্টেম্বর জার্মানি তার পুরো সীমান্তে সাময়িকভাবে নিরাপত্তা বাড়ানো শুরু করে। এতে উষ্মা প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেশীরা। জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজার স্পষ্ট করে জানিয়েছেন যে এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য শুধু ‘অবৈধ অভিবাসন’ রোধ করা নয়। একই সঙ্গে তিনি ‘ইসলামি সন্ত্রাস ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধ’ প্রতিহত করতে চান।
এ ঘোষণা এল এক মারাত্মক ছুরি হামলার পর। সেই আক্রমণে পশ্চিম জার্মানির সলিনজেনে তিনজন নিহত হয়েছিল। আক্রমণকারী ছিল এক সিরীয় শরণার্থী। তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়ের মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। তিনি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএসআইএস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল।
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, গ্রিনস এবং লিবারেলদের সমন্বয়ে গঠিত উদারপন্থী-বাম জোট এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ আরোপ করেছে কেউ এই কথা ভেবে কেউ অবাক হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো জার্মান রাজনৈতিক পটভূমিজুড়ে ডান দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। তারই সঙ্গে জুড়ে আছে ইসলামোফোবিয়া।
এই ডান দিকে ঝুঁকে পড়ার চালক হিসেবে বিশ্লেষকেরা এএফডিকে চিহ্নিত করছেন। এএফডি হলো অলটারনেটিভ ফুর দয়েশল্যান্ড নামে এক অতিডানপন্থী দল। এই ‘জার্মানির জন্য বিকল্প’ পার্টির সম্প্রতি লক্ষণীয় উত্থান ঘটেছে। দলটি জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। এই সেপ্টেম্বরের শুরুতে তারা পূর্বাঞ্চলের রাজ্য থুরিংগায় ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটে জিতেছে। পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য স্যাক্সনিতে ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এখানে মধ্য-ডান খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাটদের থেকে তারা মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্টে পিছিয়ে।
তবে এএফডির নির্বাচনী সাফল্য আসলে এই পরিবর্তনের কারণ নয়। তাদের সাফল্য বরং আরও বড় কোনো কিছুর লক্ষণ। জার্মান রাজনীতিতে এখন একটা সাধারণ প্রবণতা আছে। আর তা হলো মুসলমানদের দানব হিসেবে দেখিয়ে তাদের বলির পাঁঠা বানানো। এটা এখন স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
ক্ষমতাসীন জোটের সদস্যরা বারবার জার্মানিতে ‘ইসলামবাদের’ নিন্দা করেছে। বুন্ডেস্ট্যাগে গ্রিন পার্টির নেতা ক্যাথারিনা ড্রোজ সাম্প্রতিক বিবৃতিতে এই দাবিও করেছেন যে ‘ইসলামের বিষ শুধু বিদেশে নয়, এখানেও মানুষের মনে পৌঁছেছে’। পরে অবশ্য তিনি শুধরে নিয়ে বলেছেন যে তিনি ‘ইসলাম’ নয়, ‘ইসলামবাদ’ বলতে চেয়েছিলেন।
‘ইসলামবাদী হুমকি’ সম্পর্কে সতর্কীকরণের শব্দগুলো কেবল জার্মান রাজনীতিবিদদের মুখেই সীমাবদ্ধ, এমন নয়। সেগুলো এখন জার্মান প্রতিষ্ঠানের সব দাপ্তরিক নথি এবং নীতিমালার ঘোষণাগুলোতেও ঠাঁই নিয়েছে। প্রধান জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল অফিস ফর দ্য প্রোটেকশন অব দ্য কনস্টিটিউশনের ওয়েবসাইটে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, ‘ইসলামবাদীরা তাদের ধর্মকে কাজে লাগিয়ে ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানির মুক্ত গণতান্ত্রিক মৌলিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাতিল করার লক্ষ্যে কাজ করছে।’
এই ফেডারেল দপ্তরের ব্যাভারিয়া শাখা এখানেই থেমে থাকেনি। তারা এই ওয়েবসাইটে একটা ধারণার প্রবর্তন করেছে—‘বৈধ ইসলামবাদ’। এর সংজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে এভাবে, ‘বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক উপায়ে চরমপন্থী লক্ষগুলো অর্জন করার প্রয়াস’। আরও স্পষ্ট করতে বলা হচ্ছে, ‘আইনবাদী ইসলামপন্থীরা লবিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতি ও সমাজকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে [এবং] বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের উদার, সহনশীল এবং সংলাপের জন্য উন্মুক্ত হিসেবে হাজির করে। যদিও আসলে সংগঠনগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রবিরোধী এবং সর্বগ্রাসী প্রবণতা বজায় থাকে।’
জার্মানিতে প্রকাশ্যে অ্যান্টিসেমেটিক অনুভূতি ব্যক্ত করা নিষিদ্ধ। সেই ঘৃণা এখন প্রকাশিত হয় ইসলামোফোবিয়ার মাধ্যমে।
মূলত যারা রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে সংগঠিত হয় এবং আইনের সীমানার মধ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, এমন যেকোনো মুসলিমকে এই ধারণা ব্যবহার করে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব। মুসলমান সহনশীল বা উদার হলেও তাকে সন্দেহ করার সুযোগ তৈরি হয়।
এই ধারণাগুলোকে একটি কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করে রাজ্য এবং ফেডারেল স্তরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন’ কার্যক্রম তৈরি করেছে। এই কার্যক্রমের একমাত্র লক্ষ্য মুসলমানরা। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে অনেক সামাজিক অধিকারকর্মীরা এ ধরনের উদ্যোগের সমালোচনা করেন। কিন্তু জার্মানিতে সামগ্রিকভাবে এমন কার্যক্রম যথাযথ এবং কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়।
এমনই একটা কার্যক্রম হলো ব্যাভারিয়ান নেটওয়ার্ক ফর প্রিভেনশন অ্যান্ড ডের্যাডিক্যালাইজেশন। সম্প্রতি তারা একটা ভিডিও তৈরি করেছে। বিষয় ‘সালাফি জঙ্গিবাদ’। মুসলিম পুরুষমাত্রই মুসলিম নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়, এই বর্ণবাদী ধারণা এখানে দেখানো হয়েছে।
ব্যাভারিয়া রাজ্যে এখন কনজারভেটিভ ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের সরকার। এই মাসের শুরুতে ব্যাভারিয়ার রাজ্য সরকার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে। সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিমদের ঘৃণার দৃষ্টিতে উপস্থাপনের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ভিডিওটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে জার্মান কর্তৃপক্ষ বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের একটি নিরাপত্তাঝুঁকি এবং জার্মান সমাজের জন্য বিপদ হিসেবে বিবেচনা করে।
ভিডিওটি শেষ পর্যন্ত সরিয়ে নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদমাধ্যমের কাছে একটি বিবৃতি দিয়ে, ‘ক্ষোভ এবং ভুল–বোঝাবুঝির’ জন্য ক্ষমা চায়। সেই সঙ্গে দাবি করে যে ভিডিওটি ‘সালাফিস্ট এবং অন্য ইসলামপন্থীরা তরুণ অনুগামী সংগ্রহ করার জন্য কী উপায় ব্যবহার করে’, তা দেখানোর চেষ্টা করেছে। ভিডিওটির কিছু দৃশ্য ‘সংশোধন’ করা হবে।
কিছু বিশ্লেষক বলেছিলেন যে এই ভিডিওর সঙ্গে অ্যান্টিসেমেটিক নাৎসি প্রচারণার মধ্যে মিল আছে। অভিযোগটি হয়তো ব্যাভারিয়ান সরকারের ভিডিওটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করেছিল।
জার্মানিতে প্রকাশ্যে অ্যান্টিসেমেটিক অনুভূতি ব্যক্ত করা নিষিদ্ধ। সেই ঘৃণা এখন প্রকাশিত হয় ইসলামোফোবিয়ার মাধ্যমে। দার্শনিক মোশে জুকারম্যান তাই লিখেছেন, ইসলামোফোবিয়া হলো একটি অকথিত ইহুদিবিরোধিতার প্রকাশ।
জার্মানিতে অতিডানপন্থী শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, একটি বর্ণবাদী হিস্টিরিয়া জার্মান রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে একটি গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে। ইহুদিদের ইতিহাসের মতো এর সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি না–ও হতে পারে। পাল্টা-অভিবাসনের অতিডান ধারণাটি দ্রুত ভিত্তি লাভ করছে। গণহত্যার বদলে হয়তো গণবহিষ্কার। এই দাবি এখন মূলধারায় পরিণত হওয়ার শঙ্কা আছে। তবে সবার মনে রাখা উচিত তাদের পূর্বজরা প্রায় এক শতাব্দী আগে এমন কাজই করেছিল। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ঘৃণা কোনো ভালো কৌশল নয়।
ফরিদ হাফেজ জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ব্রিজ ইনিশিয়েটিভের সিনিয়র গবেষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত