একজন মানুষের জীবনে শিক্ষকের অবদান অপরিসীম। শিক্ষক কেবল একটি শিশুকে পাঠদানই করেন না, একটি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম, মমতা, দরদ, ধৈর্য আর ত্যাগের ফলে শিক্ষার্থীরা যেভাবে আলোকিত মানুষ হওয়ার সুযোগ পায়, তা সম্ভবত অন্য কারও তত্ত্বাবধানে সম্ভব নয়।
কিন্তু শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তাঁদের অধিকার ও সুরক্ষাকে আমরা যে অনায়াসেই এড়িয়ে যাচ্ছি, তা হয়তো নিজেরাও জানি না বা জানতে চাই না। ফলে প্রাপ্য বেতন-ভাতার দাবিতে তাঁদের কিছুদিন পর পর রাজপথে প্রতিবাদ-অনশনে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি।
এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলো অবধারিতভাবে চলে আসে, তা হলো বাংলাদেশের কোন আইনে শিক্ষকদের কাজ, অধিকার ও সুরক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে? বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ কি বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও সুরক্ষায় করণীয়র মতো শিক্ষকের অধিকার রক্ষার্থেও কোনো বিধান রেখেছে? আশ্চর্যের বিষয় হলো বাংলাদেশের কোনো আইনের আওতায়ই শিক্ষকের অধিকার স্বীকৃত নয়।
কোভিড-১৯–এর সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল ব্যবস্থায় শিক্ষকতা কীভাবে শিক্ষকের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় এ বিষয়ে দুঃখজনক কিছু তথ্য বের হয়ে এসেছে। গবেষকেরা বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের প্রায় ৫০ জন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্কুলে কর্মরত। এ শিক্ষকদের কাছেই জানা গেল শিক্ষকের পেশা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসংক্রান্ত কোনো আইনই বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ কিংবা শ্রম মন্ত্রণালয়ের পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নীতিমালার কোথাও তাঁরা নেই।
সাধু ভাষায় রচিত ৪০ পৃষ্ঠার পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নীতিমালার অধিক্ষেত্রে বলা আছে, ‘বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতভুক্ত শিল্প, কলকারখানা, প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি খাত, কৃষিভিত্তিক খামার ও অন্যান্য সকল কর্মস্থল এর আওতাভুক্ত (পৃ. ২)।’ একই পৃষ্ঠায় নীতিমালার লক্ষ্যে বলা আছে, ‘নীতিমালার সার্বিক লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সকল ব্যক্তির কর্মপরিবেশের পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি ব্যবস্থার উন্নয়ন, যাতে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মৃত্যু, জখম হওয়া বা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া ক্রমাগতভাবে হ্রাস পায় এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও বৈশ্বিক দায়িত্ব যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়।’
অর্থাৎ শিক্ষকেরা ‘বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সকল ব্যক্তি’র বাইরে বলেই তাঁদের কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত আইন বা নীতির কোথাও নেই। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হয়তো বেতন ও চাকরির নিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন, কিন্তু যে বিরাটসংখ্যক বেসরকারি বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক, কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসার শিক্ষকেরা এই আইনের বাইরে থাকার কারণে ভুক্তভোগী। কোভিডের সময় এর সম্ভাব্য পরিণতি শিক্ষকেরা ভোগ করেছেন। বিষয়টি একটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
কোভিডের সময় কোনো রকম প্রযুক্তিতে প্রবেশগম্যতা ও দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও ক্লাস পরিচালনার জন্য আবশ্যক একটা ডিভাইস (কম্পিউটার/ল্যাপটপ/স্মার্টফোন) কেনার সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও এবং বাসায় থেকে ক্লাস নেওয়ার কোনো রকম সুযোগ বা পরিবেশ না থাকা সত্ত্বেও তাঁদের অনলাইনে ক্লাস করাতে হয়েছে।
মুষ্টিমেয় কয়েকজন তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কিছু প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সুবিধা পেলেও যাঁরা সে সময় অনলাইনে ক্লাস নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই জীবনে প্রথমবার ক্যামেরা অন করে লাইভ ক্লাস করানোর উৎকণ্ঠাভরা প্রহর পার করেছেন। আর দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় ডিভাইসের সামনে থাকতে গিয়ে, রাত জেগে পাঠ্য বিষয়ের আলোচনা আপলোড করতে গিয়ে অনেকেই শিকার হয়েছেন দৃষ্টি-সমস্যার, আক্রান্ত হয়েছেন পিঠ ও মেরুদণ্ডের ব্যথায়, এমনকি কারণ হয়েছেন পারিবারিক অশান্তির।
শিক্ষককে সম্মান করার পাশাপাশি শিক্ষকের অধিকার যেন সুরক্ষিত থাকে, সে জন্য চীন, গ্রিস, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড বা কানাডা প্রভৃতি দেশের মতো ব্যবস্থা রাতারাতি গ্রহণ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের পেশা, স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমাদের আইনে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার সামর্থ্য নিশ্চয়ই আমাদের রয়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে, শিক্ষকদের ইউনিয়ন এ বিষয়ে কী করে? বাংলাদেশে শিক্ষকদের যে ইউনিয়ন রয়েছে (উল্লেখ্য, ইউনিয়নের সংখ্যা নেহাতই কম নয়), তার কোনোটিই আইনগতভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত নয় এবং যত দিন পর্যন্ত শিক্ষকের অধিকার আইনের আওতায় না আসবে, তত দিন ইউনিয়নকে আইনগতভাবে নিবন্ধনেরও সুযোগ নেই।
বর্তমানে বিদ্যমান ইউনিয়নগুলোর কিছুর রাজনীতিকীকরণ ঘটেছে, আর কিছু নিজ নিজ স্বার্থ আদায়ের জন্য মনোযোগী হয়েছে, যেমন শিক্ষা প্রশাসনসংক্রান্ত বিভিন্ন সুবিধাজনক পদপদবি দখলের প্রতিযোগিতায় তারা ব্যস্ত হয়েছে।
যে শিক্ষকের জন্য আইনের আওতায় সুরক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই, যে শিক্ষকের জরুরি প্রয়োজনে ইউনিয়ন তাঁর পাশে থাকে না, সে শিক্ষককে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ বা এ–জাতীয় বিশেষ বিশেষণে অভিহিত করলেও তাতে তাঁর প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করা হয় না মোটেও। ফলে সামাজিক দায়িত্বের নামে ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন কিংবা নির্বাচনী কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। আর কোনো কারণে সে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে শিক্ষককে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হয়। অর্থাৎ আইনে এই শিক্ষকদের জন্য করণীয় ও শিক্ষকের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ সুনির্দিষ্ট করা থাকলে এ–জাতীয় দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে প্রাথমিক শিক্ষকের সংখ্যা ৩৫৯০৯৫। আর একই বছরের ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষকের সংখ্যা ২৪৭০১৩ (ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা ও অন্যান্য প্রকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সংখ্যা ছাড়া)। তাহলে এই বিরাটসংখ্যক শিক্ষকের কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য, অধিকার উপেক্ষা রেখে আমরা কী অর্জন করতে চাই?
এ নিয়ে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের তাচ্ছিল্য বা উপেক্ষা লক্ষণীয়, তেমনি আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের মধ্যেও কি কখনো কখনো হীনম্মন্যতা কাজ করে না? শিক্ষককে ‘কর্মী’ বলা হলে তাঁর অসম্মান হয় বলে কোনো কোনো শিক্ষক মনে করতে পারেন। একটি বাস্তবতা নিশ্চয়ই পরিষ্কার যে বড় ব্যবসায়ী হোক কিংবা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা অথবা একজন শিল্পী—দিন শেষে আমরা সবাই শ্রমিক বা কর্মী, ইংরেজিতে যাকে বলে Worker বা Labor। একজন শিক্ষকের ‘কর্মী’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার মধ্যে তাই অসম্মানের কিছু নেই।
সন্দেহ নেই ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতা বা এ ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলো আমাদের দেশে শিক্ষকের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। চমৎকার এ কবিতাটির এক জায়গায় শিক্ষকের প্রতি সন্তানের আচরণে বাদশাহ আলমগীর তাঁর মর্মবেদনা প্রকাশে বলছেন—
‘নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।’
তবে কবিতাটি শেষ হচ্ছে কিন্তু বাদশাহের বন্দনায়, শিক্ষকের বন্দনায় নয়—
‘আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’
যাহোক, ভাবাবেগনির্ভর এ পঙ্ক্তিগুলো বাংলাদেশের সমাজে শিক্ষকের অবস্থান তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট। উল্লেখ্য, কবিতার রচয়িতা কবি কাজী কাদের নেওয়াজ নিজে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ১৯৪০–এর দিকে নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
কিন্তু আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, যে সময়ের কথা কবি তুলে ধরেছেন, সে সময়ে শিক্ষকের সংখ্যা, পাঠদানের প্রকৃতি, শিক্ষকের জন্য চ্যালেঞ্জ, শিক্ষার্থীর মনঃসামাজিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি ছিল একরকম, যা বিশ্বায়নের প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সময়ে একেবারেই ভিন্ন। সে সময়ে একজন শিক্ষককে একটি সচ্ছল পরিবার তার বাড়িতে রাখতে পারলে ধন্য হয়ে যেত। শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ ছিল অনুসরণযোগ্য।
আজকের ভিন্ন বাস্তবতায় শিক্ষকের অধিকার ও সুরক্ষায় তাই আইনি কাঠামো প্রয়োজন। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, তার অর্থ হলো শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার জন্য রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র শিক্ষাদান বন্ধ করলে বা শিক্ষাদান বন্ধ হওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা করলে যে কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আইনের শরণাপন্ন হতে পারেন। কেননা এই অধিকার সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে উল্লিখিত সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদও শিশুসনদে স্বীকৃত। আর শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার মূল শক্তি হলেন শিক্ষকেরা।
তাঁদের কাজ ও অধিকারের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়। শিক্ষককে সম্মান করার পাশাপাশি শিক্ষকের অধিকার যেন সুরক্ষিত থাকে, সে জন্য চীন, গ্রিস, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড বা কানাডা প্রভৃতি দেশের মতো ব্যবস্থা রাতারাতি গ্রহণ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের পেশা, স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমাদের আইনে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার সামর্থ্য নিশ্চয়ই আমাদের রয়েছে।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
ড. তৌহিদ হোসেন খান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
মোহাম্মদ ইমাম হোসেন অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও বাংলাদেশের শ্রম আইন গ্রন্থের লেখক।