বাংলাদেশে গত দুটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য—কোনোটাই হয়নি। এ দুই নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ বা তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী মহলও নির্বাচন দুটিকে খুব জোর গলায় ‘গ্রহণযোগ্য’ হিসেবে দাবি করেন না। আর জনগণ যেহেতু ভোট দিতে পারেননি, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অনিয়ম ও কারচুপি দেখেছেন, তাই তাঁরা নির্বাচন দুটিকে সুষ্ঠু বলে মনে করেন না।
এখানে বলে রাখা ভালো, ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন ও ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলেও অনেক সময় ‘গ্রহণযোগ্য’ হয়। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি মূলত নির্ভর করে একটি দেশের নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির ওপর।
২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৫৪ জন। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীরা পেয়েছিল কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই। বিএনপি যেহেতু নির্বাচন বর্জন করেছে, তাই সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার দায় বিএনপির ওপর অনেকটাই চাপানো যায়। আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী মহল তখন একটি সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেয়ে সংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার গুরুত্বকেই বড় করে দেখাতে চেয়েছে।
২০১৪ সালের গ্রহণযোগ্যতাহীন নির্বাচনের দায় না হয় বিএনপির ওপর চাপানো গেল, অথবা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে জায়েজও করা গেল, কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্রে যুক্তি বা ব্যাখ্যা কী? এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল। গ্রহণযোগ্য না হওয়ার দায় বিএনপির ওপর চাপানোর সুযোগ নেই। এ নির্বাচন সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারকাছ দিয়েও যায়নি, কারণ যে ভোট দিনে হওয়ার কথা তা হয়ে গেছে আগের রাতে। এ ধরনের অভিনব ও মাত্রাছাড়া অনিয়মের কারণে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ‘রাতের ভোট’ কথাটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের লোকজনের মুখেও শোনা গেছে। (আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট দিনেই হবে। রাতে কোনো ভোট হবে না।—নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান)। আবার সরকারি দলের লোকজনও যখন বলেন, আগামী নির্বাচন ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো হবে না, তখন বোঝা যায় সে নির্বাচনকে তাঁরা নিজেরও গ্রহণযোগ্য মনে করেন না।
আগেই বলেছি, ভোট সুষ্ঠু না হলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বিষয়টি এবার একটু ব্যাখ্যা করছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ করত, অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি আসনে যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন না হতো এবং অনিয়ম-কারচুপির মধ্যেও সেই নির্বাচনে যদি বিএনপি ‘সম্মানজনক’ আসন পেত, তাহলে সেই নির্বাচন কোনো না কোনো মাত্রায় ‘গ্রহণযোগ্যতা’ পেত। আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন করা যে প্রায় অসম্ভব, সে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। ফলে, এমন নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলনও ঘটে না বা ঘটতে দেওয়া হয় না। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে অনেকে ধরে নিয়েছিল যে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে অন্তত সম্মানজনক সংখ্যার আসনে জিততে দেওয়া হবে। যদি তা হতো, তবে ভোট দিনে বা রাতে যখনই হোক না কেন, সেই নির্বাচনও একধরনের গ্রহণযোগ্যতা পেত। আওয়ামী লীগ সেটা হতে দেয়নি বা দিতে পারেনি। সমালোচকেরা বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ের ওপর দলের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কাজ করেনি। সরকারি দলের প্রার্থী ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসন মিলেমিশে কাজ সেরে ফেলেছে।
জনগণ আগামী নির্বাচনে ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আশায় রয়েছেন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন। কিন্তু ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সামনে যে নির্বাচন করতে চাইছে, সেখানে একটি ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচনের চেয়েও দলটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের আয়োজন। অর্থনৈতিক সংকটে পড়া সরকারের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ বাড়ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন বা জনগণের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হোক বা না হোক, সরকারকে এখন অন্তত বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পক্ষে সেটা কতটা সম্ভব? আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনে দলের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থান্বেষী একটি অংশের ভাগবাঁটোয়ারা ও লেনদেনের সম্পর্ক হয়ে গেছে। নিজেদের স্বার্থেই সুবিধাভোগী এ গোষ্ঠী বর্তমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে। এখন দল আওয়ামী লীগ যদি সুষ্ঠু বা নিদেনপক্ষে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও নেয়, তাহলেও কি তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব? যারা বর্তমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগী, তারা কি আওয়ামী লীগকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে দেবে?
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এ নির্বাচনের সঙ্গে সরকার গঠন বা সরকারের টিকে থাকার সম্পর্ক ছিল না। তা ছাড়া এ নির্বাচনে বিএনপিও অংশ নেয়নি। দেখা গেল, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে সেখানকার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে যে নির্বাচনে জেতার জন্য তারা কোনো কিছুরই পরোয়া করে না। নিরাপত্তা বাহিনীর ৩ হাজারের মতো সদস্য মোতায়েন, ১৪৫টি কেন্দ্রে প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ইভিএমে ভোট করার পরও যদি নির্বাচন বাতিল করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তবে সারা দেশে একসঙ্গে ৩০০ আসনে সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ভরসা কোথায়?
আওয়ামী লীগ যদি তার সরকারে অধীন নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় থাকে এবং সেই নির্বাচনকে যদি গ্রহণযোগ্য করতে চায়, তবে তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ লাগবেই। আওয়ামী লীগ কী আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিএনপিকে ভোটে নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটা এক বড় কৌতূহলের বিষয়।
গাইবান্ধা উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন না করলে নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়গুলো আদৌ আমলে নেওয়া হতো কি? নির্বাচন বাতিলের পর বিস্ময়করভাবে ৯১ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন ভাষায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি পাঠিয়েছেন। অভিযোগ আছে, এ চিঠি দিতে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের বাধ্য করা হয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের এ চিঠি দেওয়াকে অত্যন্ত গর্হিত এবং আইনবহির্ভূত কাজ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, এ উপনির্বাচনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কাজেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে প্রতিবেদন পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন যে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষায় কোনো রাখঢাক ছাড়াই তৎপর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্থানীয় পর্যায়ের এ প্রশাসনকে উপেক্ষা করে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কি ভোটের আয়োজন সম্ভব?
নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার সবচেয়ে জরুরি শর্ত হচ্ছে নির্বাচনে দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির অংশগ্রহণ। দলটি এখনো বলে আসছে, বর্তমান সরকারে অধীন তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। তারা বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চায় এবং দলনিরপেক্ষ কোনো সরকার অধীন নির্বাচন চায়। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ জোরের সঙ্গেই বলে চলেছে যে সংবিধান অনুযায়ী তাদের সরকারের অধীনই নির্বাচন হবে। পুরোনো কথা, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। রাজনীতিতে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অনেক দেনদরবার চলে। বিএনপির ট্র্যাজেডি হচ্ছে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে তারা যে ভুল করেছিল, তা সামাল দিতে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। দেখা গেল, সেটা ছিল তাদের জন্য আরও বড় ভুল। আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে তারা পরপর দুবারই মার খেয়েছে। এবার শেষ পর্যন্ত বিএনপি কী করবে, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
আওয়ামী লীগ যদি তার সরকারে অধীন নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় থাকে এবং সেই নির্বাচনকে যদি গ্রহণযোগ্য করতে চায়, তবে তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ লাগবেই। আওয়ামী লীগ কী আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিএনপিকে ভোটে নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটা এক বড় কৌতূহলের বিষয়। সেটা কি সুষ্ঠু ভোটের প্রতিশ্রুতি, সম্মানজনক আসন দেওয়ার আশ্বাস, আসন ভাগাভাগি, নাকি অন্য কোনো সমঝোতা? তবে এসব ছাপিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করবে? তাদের কোনো আশ্বাসের ওপর আস্থা রাখবে?
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক। ইমেইল: [email protected]