নির্বিচার জেলে ভরে কেন সংকট বাড়ানো হচ্ছে

সিএমএম কোর্ট প্রাঙ্গণে গণগ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরাছবি: দীপু মালাকার

বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার খিলগাঁও থেকে ৭৫ বছর বয়সী এক ভদ্রলোক টেলিফোন করে বললেন, তাঁদের এক ভাই বিএনপি করেন বলে তাঁকে না পেয়ে আরেক ভাই, ভাইয়ের ছেলে, ভাগনে ও এক ভগ্নিপতিকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে নিয়ে গেছে। তাঁরা বলেছেন, বিএনপি করা ভাইকে ধরিয়ে দিলে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।

ভদ্রলোক আক্ষেপ করলেন যে ওই ভাইয়ের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ নেই। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক। বর্তমানে ক্যানসারে আক্রান্ত। কিছুক্ষণ আগে কেমোথেরাপি দিয়ে এসেছেন হাসপাতাল থেকে। তাঁর ভাইয়ের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও ভাগনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। দরজা খুলতে দেরি করায় গৃহকর্মীকেও পুলিশ মারধর করেছে। পুরো পরিবার মহা দুশ্চিন্তায় আছে। 

প্রথম আলোকে ফোন করে আরেক বন্ধু জানান, পূর্ব রামপুরা সোনালী ব্যাংকের গলিতে স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষিকা থাকেন তাঁর ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে লাবিবা জাহান ঐশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের শিক্ষার্থী। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেও এখনো চাকরি পাননি, বেকার। 

বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশ দরজা ধাক্কা দিলে তাঁরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরে পুলিশ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ছেলে আন্দোলনে গিয়েছেন কি না, তাঁর গায়ে কোনো গুলির দাগ বা আহত হওয়ার চিহ্ন আছে কি না, তা দেখে। কিছুই পাওয়া না গেলেও তাঁকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। সবার মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয়। যদিও তাতে আন্দোলন–সম্পর্কিত কিছু ছিল না।

ঐশী সম্পর্কে তাঁর বন্ধুদের ভাষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়ালেও তিনি এর সঙ্গে  যুক্ত ছিলেন না, এমনকি ফেসবুকে এ নিয়ে তেমন মন্তব্যও করেননি। ভুক্তভোগী মা ও মেয়ে এখন এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন। তাঁরা ভীষণ শঙ্কিত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। 

কেবল ওই ৭৫ বয়সী মুক্তিযোদ্ধা কিংবা স্কুল শিক্ষিকার পরিবার নয়; এ রকম হাজার হাজার পরিবার স্বজনের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় আছে। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছে। সবার পক্ষে থানা–আদালতে দৌড়াদৌড়ি করাও সম্ভব নয়। 

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সংঘর্ষ-সহিংসতায় উত্তাল ছিল বাড্ডা-রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর এলাকা। এসব স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। যাঁরা মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন, প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ। 

ঢাকায় পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান নিয়ে বিবিসি বাংলার একটি ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায়, মঙ্গলবার বেলা তিনটার দিকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকগুলো প্রিজন ভ্যান গ্রেপ্তারকৃতদের নিয়ে আদালতপাড়ায় এসে পৌঁছায়। ভেতরে আটক বন্দীরা চিৎকার করে বলছেন, ‘আমরা নির্দোষ। আমরা কোনো আন্দোলনে ছিলাম না। বিনা দোষে আমাদের আটক করা হয়েছে।’ তাঁদের মধ্যে শিক্ষার্থী যেমন আছেন, তেমনি আছেন খেটে খাওয়া মানুষ। আছে কিশোর–তরুণেরাও। 

প্রিজন ভ্যানের পাশে অনেক নারী–পুরুষের ভিড়। কেউ গাড়ির ভেতরে থাকা স্বজনকে দেখার চেষ্টা করছেন। একজন বললেন, তাঁর ভাই সিএনজিচালক। আন্দোলনে ছিলেন না। তিনি রাস্তার পাশ থেকে দুই পক্ষের গোলমাল দেখছিলেন। সন্দেহের বশে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে। ড্রোন থেকে ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়েছে। সেই ছবিতে যাঁরা এসেছেন, সবাইকে ধরছেন। 

আরেকজন ভদ্রমহিলা জানালেন, মাতুয়াইল থেকে তাঁর মেয়ের জামাইকে ধরে এনেছে পুলিশ। তিনি রাস্তার পাশের দোকানে বসে অন্যদের সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন। পুলিশের গাড়ি দেখে সবাই পালাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁকে ধরে ফেলে। আরেকজনের ভাষ্য এ রকম: বিএনপি করেন বলে তাঁর ভাইকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু তাঁর ভাই কোনো আন্দোলনে ছিলেন না। স্ট্রোক করায় বাসায়ই ছিলেন। রাতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। আরেক মা বললেন, তাঁর ১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে আসা হয়েছে। সে একটি গ্যারেজে কাজ করত। 

আসলে ঢাকার যেসব এলাকায় বেশি বিক্ষোভ ও ভাঙচুর হয়েছে, সেসব এলাকা থেকে বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কে জড়িত ছিলেন, কে ছিলেন না, সেটা বাছবিচার করা হচ্ছে না। 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যাঁরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসে যুক্ত ছিলেন, চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু বিরোধী দলের কোনো নেতার আত্মীয়স্বজন কিংবা বয়সে তরুণ হলেই তাঁকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে কেন? 

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ, হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মামলা ও গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঢাকাসহ ৫১টি মহানগর-জেলায় ৫২৫টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৯ দিনে (১৭ থেকে ২৫ জুলাই) সারা দেশে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। বুধবার রাত থেকে গত বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০ জনকে। রাজধানীতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৫১ জনকে।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। ঢাকা শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি সদস্য কম ছিলেন না। তাঁরা রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করতে না পেরে এখন পাইকারি গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছেন। যাঁরা নাশকতা করেছেন, তাঁদের ধরুন। কিন্তু শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষ, নিরীহ পথচারী ও খেটে খাওয়া মানুষকে গ্রেপ্তারের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কথা দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হবে না। তঁাদের হয়রানি করা হবে না। এখন বেছে বেছে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিকে ঘিরে আরও পাঁচটি মামলায় শিক্ষার্থীদের আসামি করা হয়েছে। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছে পুলিশ। আরেকটি মামলায় আসামিদের তালিকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ শিক্ষার্থীর নাম। 

এ ছাড়া পুলিশকে মারধর ও জখম করা এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর রূপনগর থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিইউবিটির (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি) অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। দুটি মামলায় অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীসহ এক থেকে দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এর বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অজ্ঞাতনামা ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে ঢাকার আশুলিয়া থানায় আরেকটি মামলা হয়েছে। 

সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, সহিংসতা বা ধ্বংসযজ্ঞ চালাননি। তাঁরা সহিংসতার ঘটনাগুলোর জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকেই দায়ী করে আসছেন। শিক্ষার্থীরা যদি সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ না চালিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হলো কেন?

শুক্রবার এ লেখার শেষ মুহূর্তে জানলাম বিএনপি নেতার ওই ভাইয়ের পরিবার–পরিজনকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। নির্বিচার গ্রেপ্তার হওয়া বাকিদের বেলায়ও তেমনটি ঘটুক।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]