বিশ্বের রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া বোঝা আমার জন্য জটিল বিষয়। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া নিয়েই ভাবা যাক। মনে হতে পারে, এ বিষয়ে ভাবা কি খুব জরুরি? উত্তর হলো, দায়িত্ববান ও সচেতন একজন নাগরিক হিসেবে এটি খুবই জরুরি, যার ফলস্বরূপ দেশের উন্নতির প্রক্রিয়া চলমান থাকে।
বাংলাদেশের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই অসুস্থ রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া বিদ্যমান। শুধু সুস্থ রাজনীতিই পারে দেশের উন্নতি চলমান রাখতে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাহমুদ হোসেন ২০ আগস্ট পদত্যাগ করলেন। অবিশ্বাস্য ঘটনা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এই পদত্যাগ চাননি এবং বিষয়টি মেনে নিতে তাঁদের কষ্ট হয়েছে। কারণ, তাঁরা ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’–এর সময় সরাসরি তাঁর সমর্থন পেয়েছিলেন, যেহেতু আন্দোলনটি ছিল যৌক্তিক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।
ওই সময় ঘটে যাওয়া উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পুলিশ প্রশাসনের প্রবেশের বিষয়টি তিনি শক্তভাবে দমন করেছিলেন। ফলে, পুলিশ প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে পারেনি। তখনকার পরিস্থিতিতে তারা ভেতরে ঢুকতে পারলে সেখানে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে যেত বলে ধারণা করি। তিনি বলেছিলেন, ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো পুলিশ ঢুকবে না, এখানে আমিই প্রশাসন।’
নিজের সমস্যার কথা বিবেচনায় না নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভালোবেসে তাঁদের যাতে কোনো বিপদ না আসে—এমন সাহসী উদ্যোগ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। এমন একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি পাওয়া দুষ্কর এবং তিনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে আমার বিশ্বাস। কারণ, সেই দুঃসময়ে আর কোনো উপাচার্যের এমন সাহসী উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পরিবর্তে তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো!
এখন প্রশ্ন হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী উপাচার্য কে হবেন? ঘটে যাওয়া দুঃসময়ে শুধু নিজের জীবনকে বাঁচাতে ব্যস্ত থাকা মানুষকে এই পদে অভিষিক্ত করা হলে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’–এর মৃত্যু ঘটবে! সেই সঙ্গে যাঁরা সমাজসংস্কারে নেমেছেন, তাঁরা সমাজে প্রশ্নবোধক চিহ্নটির চর্চায় ব্যস্ত আছেন বলে মনে হবে! আর এটির আত্মপ্রকাশ ঘটলে বলব ‘অসুস্থ রাজনীতি’ বিরাজমান।
বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা গেলে ‘সুস্থ রাজনৈতিকীকরণ’ দেশের সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো এবং দেশের উন্নতি হতো। সেই সঙ্গে সংস্কারের কাজে যাঁরা নেমেছেন, তাঁদের সার্থকতা শতভাগ পূর্ণ হতো এবং নামগুলো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত।
আর যদি দলীয়করণের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তো তিনি হবেন কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের উপাচার্য। শুধু তাঁদের স্বার্থ রক্ষার কাজেই তিনি বহাল থাকবেন! সে ক্ষেত্রে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা শিক্ষকদের পদত্যাগ নিয়ে তামাশা করার কি কোনো প্রয়োজন আছে? সে ক্ষেত্রেও ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ ও ‘সমাজসংস্কার’ সাংঘাতিকভাবে অকার্যকর হয়ে যাবে। ফলে যার অর্থ দাঁড়াবে এমন, তা হলো, ‘একটি ভাড়াটেকে উঠিয়ে অপরিষ্কার বাসা মেরামতের কাজ শেষে আরেকটি ভাড়াটেকে বাসা ভাড়া দেওয়ার মতো।’ এরপরে আবারও রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে ভাড়াটে বদলের প্রক্রিয়ার...চলমান...। সেটিও ‘অসুস্থ রাজনীতি’।
তাই যে দলেরই হোন না কেন, দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মাহমুদ হোসেনের মতো পরোপকারী, দায়িত্বশীল ও যোগ্য মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ সার্থক হতো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সত্যিকারের বা যথার্থই সংস্কার করা সম্ভব হতো। ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ ও ‘সমাজসংস্কার’–এর সর্থকতা প্রায় শতভাগ সফল হতো। এটিই হলো ‘সুস্থ রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া’।
বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা গেলে ‘সুস্থ রাজনৈতিকীকরণ’ দেশের সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো এবং দেশের উন্নতি হতো। সেই সঙ্গে সংস্কারের কাজে যাঁরা নেমেছেন, তাঁদের সার্থকতা শতভাগ পূর্ণ হতো এবং নামগুলো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকত।
শাপলা শিরিন
অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়