২০২৫ সাল হয়তো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে শুরু করবে: ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) কি বিশ্বরাজনীতিতে নতুন শক্তির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠছে? গোষ্ঠীটি নতুন সদস্য (মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) যুক্ত করে এখন বিশ্বের ৪৫ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করছে।
ফলে, কেউ কেউ মনে করছেন, এটি ‘গ্লোবাল সাউথ’ বা ‘বিশ্ব দক্ষিণ’–কে একত্র করে আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। তবে এমন দাবির ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।
২০০১ সালে যখন জিম ও’নিল (তৎকালীন গোল্ডম্যান স্যাকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ) ‘বিআরআইসি’ বা ‘ব্রিক’ শব্দটি প্রবর্তন করেন। তখন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কেবল চারটি উদীয়মান অর্থনীতিকে চিহ্নিত করা, যেগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আধিপত্য বিস্তার করার সম্ভাবনাকে ধারণ করে।
কিন্তু শব্দটি দ্রুত রাজনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করে। এটি প্রথম ২০০৬ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয় এবং পরে ২০০৯ সালে প্রথম ব্রিক শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে একটি আনুষ্ঠানিক সংগঠনে রূপ নেয়।
রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এখনো সে লক্ষ্যেই কাজ চলছে। পরবর্তী বছরের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা এর সঙ্গে যুক্ত হলে গোষ্ঠীটি ‘এস’ যুক্ত করে ‘ব্রিকস’ নামে পরিচিত হয়।
ওয়াল স্ট্রিটের একটি আর্থিক ধারণা (অ্যাসেট ক্লাস) ধীরে ধীরে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। কারণ, এটি রাশিয়া ও চীনের বিকাশমান বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছার সঙ্গে মিলে গেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ব্রিকসের ১৬তম শীর্ষ সম্মেলন প্রথমবারের মতো নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করেছে (সৌদি আরব এখনো গোষ্ঠীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং আর্জেন্টিনার নতুন সরকার অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে)।
৩৬টি দেশের নেতা এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই সুযোগে তুরস্কও এই গোষ্ঠীর সদস্যপদের আবেদন উপস্থাপন করেছে।
২০২৪ সালের শীর্ষ সম্মেলনে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বা ‘বিশ্ব দক্ষিণ’–এর মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী করা এবং বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়।
ব্রিকসকে একটি সংগঠন হিসেবে সীমাবদ্ধ করার আরও বড় কারণ হলো চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। যদিও চীন ভারতের তুলনায় অনেক ধনী; তবে রাশিয়ার মতো চীনও জনসংখ্যাগত সংকটে পড়ছে। অন্যদিকে ভারতের জনসংখ্যা ও কর্মশক্তি ক্রমাগত বাড়ছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই সম্মেলন ব্যবহার করে দেখাতে চেয়েছেন, ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণের পরও তিনি বিশ্বকূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছেন।
আরও অনেক দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহ দেখানোয় গোষ্ঠীটি সত্যিই মার্কিন আধিপত্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিতে পারে বলে মনে হচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে শীতল যুদ্ধ-যুগের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (নন-অ্যালায়েন্ড মুভমেন্ট, সংক্ষেপে ন্যাম) উত্তরসূরি হিসেবে দেখছেন।
ওই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কোনো পক্ষকে বেছে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তবে ন্যামের একটি সাধারণ উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করা। কিন্তু এটি কখনো রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিধর দেশগুলোকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেনি।
সে যা–ই হোক, ব্রিকসের পক্ষে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বা ‘বিশ্ব দক্ষিণ’–কে আনুষ্ঠানিকভাবে একত্র করা সম্ভব নয়। কারণ, এর সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সদস্য—চীন, ভারত ও রাশিয়া—সবাই উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত। এই তিন দেশই নেতৃত্বের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি মনে করে। তারা নিজেদের মধ্যে ‘সীমাহীন মিত্রতা’ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই ধরনের কথা তাদের কৌশলগত মতভেদের বড় পার্থক্যকে আড়াল করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন চীন দুর্বল ছিল, রাশিয়া তখন তাদের অনেক জমি দখল করেছে। এখন চীনের অর্থনীতি রাশিয়ার তুলনায় ১০ গুণ বড়। দুই দেশই মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে রাশিয়া যখন উত্তর কোরিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে সাহায্যের জন্য টানছে, তখন চীন অস্বস্তি বোধ করছে।
ব্রিকসকে একটি সংগঠন হিসেবে সীমাবদ্ধ করার আরও বড় কারণ হলো চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। যদিও চীন ভারতের তুলনায় অনেক ধনী; তবে রাশিয়ার মতো চীনও জনসংখ্যাগত সংকটে পড়ছে। অন্যদিকে ভারতের জনসংখ্যা ও কর্মশক্তি ক্রমাগত বাড়ছে।
তা ছাড়া চীন ও ভারতের মধ্যে হিমালয়ে একটি বিরোধপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে। সেখানে তাদের সেনারা বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে চীনের পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বের কারণে।
আসলে চীনের ব্যাপারে ভারতের দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগই ভারতের ব্রিকসে অংশগ্রহণের অন্যতম কারণ। যদিও ভারত আনুষ্ঠানিক জোট এড়িয়ে চলে, তবু একই কারণে দেশটি ‘দ্য কোয়াড’–এ (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গঠিত) অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে।
তবে নতুন সদস্যদের যোগ দেওয়ার ফলে ব্রিকস আরও শক্তিশালী না হয়ে বরং আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে এসেছে। মিসর ও ইথিওপিয়া নীল নদে ইথিওপিয়ার বাঁধ তৈরি নিয়ে বিরোধে লিপ্ত রয়েছে। ইরান দীর্ঘদিন ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সম্ভাব্য সদস্য সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধে আছে।
এই নতুন অভ্যন্তরীণ বিরোধগুলো ব্রিকসকে আরও কার্যকর করার বদলে তার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে। জি–৭৭ গোষ্ঠীতে আরও অনেক সদস্য রয়েছে। কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ বিভক্তির কারণে গোষ্ঠীটির ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে।
২০২৪ সালের শীর্ষ সম্মেলনে ব্রিকস+ অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানো এবং অবকাঠামো ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু এই ধরনের আলোচনা সাধারণত বড় ফলাফল নিয়ে আসে না।
২০১৪ সালে ব্রিকস নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। এর সদর দপ্তর সাংহাইতে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারেনি।
তেমনি ডলার পরিহারের এবং সদস্যদেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নিজেদের মুদ্রায় পরিচালনা করার পরিকল্পনাও সীমিত গতিতে এগিয়েছে।
ডলারকে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিস্থাপন করার জন্য চীনকে রেনমিনবি সমর্থন করতে হলে গভীর, নমনীয় পুঁজিবাজার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এই শর্তগুলো এখনো পূর্ণ হয়নি।
তাহলে ব্রিকস কী কাজে আসে? কূটনৈতিক একঘেয়েমি থেকে বের হওয়ার একটি উপায় হিসেবে এটি রাশিয়ার জন্য অবশ্যই উপকারী। উন্নয়নশীল বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে এটি চীনের জন্যও উপকারী হয়েছে।
চীনকে প্রতিরোধ করার একটি চ্যানেল হিসেবে ভারতের জন্য এর কিছু ব্যবহার আছে। জাতীয় উন্নয়ন প্রদর্শনের একটি মঞ্চ হিসেবে এটি ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য মাঝেমধ্যে উপকারী হয়েছে।
তবে এসব কার্যক্রম ব্রিকসকে কি বিশ্বরাজনীতির একটি নতুন কেন্দ্রবিন্দু বানাতে পারে? আমি মনে করি, পারে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জোসেফ এস নাই জুনিয়র হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমেরিটাস ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী।