ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। এই মাসে ভারতের সঙ্গে ক্রিকেটে বাংলাদেশ সিরিজ জয় করেছে। মাস কয়েক আগে আমাদের মেয়েরা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এই ফুটবল টিমে যাঁরা খেলেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে। অভিভাবকদের সক্রিয় সহায়তা ও অদম্য সাহসের জোরেই তাঁরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ তাঁদের শ্রম-ঘাম ও মেধা দিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, তার প্রধান শক্তি কৃষক, প্রবাসে ও দেশের ভেতরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা শ্রমিকেরা।
এই বিজয়ের মাসে বিএনপির সমাবেশের স্থানকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকার প্রাণহানি ছাড়া সমাবেশের স্থান ঠিক করতে পারে না, তাদের কাছে দেশবাসী কী আশা করতে পারে?
২.
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম যে কর্মসম্পর্ক থাকার কথা, তা এখন নেই। আগেও ছিল না। ক্ষমতাসীনেরা বরাবর পূর্বসূরির খারাপ নীতিগুলো অনুসরণ করে থাকেন। বিএনপি আমলে বিরোধী দলের সমাবেশ আটকানো হয়েছে, আওয়ামী লীগ আমলেও হচ্ছে। সমানে সমান। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের এক বন্ধু সাংবাদিকেরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে এক পাল্লায় মাপেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে সবিনয়ে বললাম, তাঁরা তাঁদের কাজ দিয়ে বিএনপির সঙ্গে নীতিগত দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলেছেন। এখন স্লোগান ও পোশাক ছাড়া দুই দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন, তাঁরা যা বলছেন, যা করছেন, সেটাই উত্তম। সবাইকে অবনত মস্তকে গ্রহণ করতে হবে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪–দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল, যাদের লক্ষ্য ছিল একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন ও একসঙ্গে সরকার গঠন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়, তাতে ১৪ দলের শরিক থেকে সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ও জাতীয় পার্টির জি এম কাদের মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে ও পরে মন্ত্রী হন জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু। ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তাঁরা মন্ত্রী ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগ এককভাবে সরকার গঠন করে, যাতে শরিকদের জায়গা হয়নি, এমনকি জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দল না সরকারের সহযোগী, তারও মীমাংসা হয়নি গত চার বছরে। নির্ভেজাল আওয়ামী লীগ সরকার আগের শরিকদের নিয়ে গঠিত সরকারের চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পেরেছে, এই দাবি কেউ করবে না। গত বৃহস্পতিবার ১৪ দলের বৈঠকে শরিক দলগুলো আওয়ামী লীগের ‘একলা চলো নীতিতে’ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লেই শরিকদের ডাকে। আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছে। অথচ শরিকদের সঙ্গে আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করেনি। আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন একটি শরিক দলের নেতা। তবে আওয়ামী লীগ যত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক না কেন, শরিকেরা ১৪–দলীয় জোটে থাকবে, সেই ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন।
এই যে কয়েক দিন ধরে দেশে একটা অস্থির অবস্থা চলছে, এতে রাজনীতিকদের কিছু না হলেও সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ ভীষণ উৎকণ্ঠায় আছে। তাঁদের বৃহত্তর অংশ কোথায় কার সম্মেলন বা সমাবেশ হলো, তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন। তাঁরা চান তাঁদের জীবিকা যেন বন্ধ না হয়। যেদিন কাজ বন্ধ থাকবে, সেদিন না খেয়ে থাকতে হবে। ক্ষমতার রাজনীতি এই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবে না।
৩.
রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে শনিবার বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। শুক্রবার বিকেলে এ ঘোষণা আসার পর থেকে মাঠে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা আসতে থাকেন। সন্ধ্যা নাগাদ মাঠের একাংশ ভরে যায়। গোলাপবাগ মাঠে শনিবার বেলা ১১টায় বিএনপির সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘কাল বেলা ১১টায় সমাবেশ শুরু হবে। গোলাপবাগে মঞ্চ তৈরি, মাইক লাগানো এবং নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সহযোগিতা চাই আমরা।’
প্রায় তিন মাস আগে বিএনপি ১০ বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর গণসমাবেশ করতে নয়াপল্টনের জন্য অনুমতি চেয়ে গত ১৩ নভেম্বর ও ২০ নভেম্বর ডিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করেছিল বিএনপি। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়। কিন্তু ডিএমপি বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলে। এই বিতর্কের মধ্যেই ৭ ডিসেম্বর দলীয় অফিসের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এরপর পুলিশ দলীয় অফিসে অভিযান চালিয়ে সেখানে অবস্থানরত সবাইকে গ্রেপ্তার করে এবং অফিস তালা ঝুলিয়ে দেয়। বিএনপি দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় না থাকলে হয়তো এ সংঘাত ও গ্রেপ্তার এড়ানো যেত। দুই সপ্তাহ আগে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম, সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপির জেদ করা ঠিক হবে না। গোলাপবাগ মাঠ কি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চেয়ে বড়? যদি না হয়ে থাকে, কেন সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেন? যদি তাঁরা মনে করেন, সমাবেশ নিয়ে সরকারের কোনো দুরভিসন্ধি আছে, তাহলেও তাঁদের এ অনড় অবস্থান দলকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করল, তেমনি সরকারকে অভিযান চালানোর সুযোগ করে দিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাস্তবতা বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
৪.
বিএনপির সমাবেশের স্থান নিয়ে বিতর্ক চলাকালে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে সরকার। দূরপাল্লার প্রতিটি বাস থামিয়ে দেখছেন। কেবল বাস নয়, অটো মাইক্রো ও ব্যক্তিগত গাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। পরিবহনমালিকেরা বলেছেন, ঢাকায় বাস চলাচল সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। আগের সমাবেশগুলোতে ছিল পরিবহন ধর্মঘট। এবার পরিবহন রেশনিং। আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষায় বিএনপির মতো একটি ‘দুর্বল দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার ও সরকারি দল গত কয়েক দিন ধরে যেই তৎপরতা চালিয়েছে, তাতে নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। বিএনপির সমাবেশ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা কেন পাহারা দেবেন? সরকার যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, পাহারার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পাহারার দায়িত্ব জনপ্রশাসনের। সেই দায়িত্ব কোনো দলের নেতা-কর্মীরা নিলে সরকারের প্রয়োজন কী? বিএনপির সমাবেশ সামনে রেখে যেমন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাহারা বসিয়েছেন, বিএনপির নেতা-কর্মীরা একইভাবে পাহারা বসালে দেশের কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা–ও নেতা-নেত্রীদের ভাবা উচিত। একটি অন্যায়ের প্রতিকার আরেকটি অন্যায় দিয়ে হতে পারে না।
এই যে কয়েক দিন ধরে দেশে একটা অস্থির অবস্থা চলছে, এতে রাজনীতিকদের কিছু না হলেও সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ ভীষণ উৎকণ্ঠায় আছে। তাঁদের বৃহত্তর অংশ কোথায় কার সম্মেলন বা সমাবেশ হলো, তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন। তাঁরা চান তাঁদের জীবিকা যেন বন্ধ না হয়। যেদিন কাজ বন্ধ থাকবে, সেদিন না খেয়ে থাকতে হবে। ক্ষমতার রাজনীতি এই মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি