২০২০ সালে কোভিড-১৯ আঘাত হানার পর যে বিশৃঙ্খলা ও দুর্দশাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা দেখে মনে আশা জেগেছিল। মনে হয়েছিল, এই বৈশ্বিক ট্র্যাজেডি থেকে এবার হয়তো কোনো আশাবহ কিছু বেরিয়ে আসবে। অল্প সময়ের জন্য হলেও এটিকে সম্ভব বলে মনে হয়েছিল।
করোনার সময় আমাদের সবার ওপর যে নাজুক অবস্থা নেমে এসেছিল এবং আমরা যেভাবে পারস্পরিক সহমর্মিতা দেখিয়েছিলাম, তা আমাদের ভৌগোলিক সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক সংহতি প্রকাশের একটি সুযোগ করে দিয়েছিল। ওই সময় আমাদের সাধারণ সংহতিকে মনে করিয়ে দেওয়ার স্মারক হিসেবে মহামারিটি ভূমিকা রেখেছিল।
এখন আমি ভাবি, ওই সময় আমার আশা করাটাও ভুল ছিল কি না। কারণ, যেই মাত্র মহামারি চলে গেল, অমনি আমরা আবার আগের চেহারায় ফিরে গেলাম। আমাদের সংহতি-সহমর্মিতার পাঠ আবার উবে গেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার সবগুলো না হলেও অনেকগুলোই ভেঙে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে।
শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ বাদ দিয়ে সামরিক সংঘাতই এখন দেশের সঙ্গে দেশের (যেমন: রাশিয়া ও ইউক্রেন) এবং দেশের ভেতরের বিবদমান পক্ষগুলোর (যেমন: ইয়েমেন ও সুদান) মতবিরোধ নিষ্পত্তির মোক্ষম পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নেতৃত্বাধীন বহুপক্ষীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা একেবারে অপ্রাসঙ্গিকতার দিকে চলে যাচ্ছে।
এখন বৈশ্বিক উত্তর এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের বৈষম্যের ব্যবধান আরও চওড়া হয়েছে। বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর বেশির ভাগই ঋণের বোঝায় দিন দিন নুয়ে পড়ছে। এর ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। অভিবাসন বেড়েছে। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের বীজ রোপিত হয়েছে।
জনতুষ্টিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের বাড়বাড়ন্তর সঙ্গে সঙ্গে মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ তীব্র হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্রুত যেন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধেয়ে যাচ্ছে।
পশ্চিমা এবং আরব ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে এখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে। গাজার নারকীয় অবস্থা দেখে পশ্চিমা ও আরব জনগণ তাদের নেতাদের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তাদের দেশের শহরের রাস্তায় রাস্তায় নেতাদের প্রতি ক্রোধে ভরা বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে।
সবকিছু যেন বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে আগের চেয়ে নাজুক করে ফেলছে। তবে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ বিশ্বব্যবস্থার জন্য চরম আঘাত হয়ে নেমে এসেছে।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের চরম লঙ্ঘন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাদানের বিশ্বাসের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। এটি আমরা প্রথমে ইসরায়েলে (৭ অক্টোবর হামাসের হামলায়) দেখেছি। এখন গাজায় দেখছি। দুটি জায়গাতেই আমরা মানবতার চরম অপমান দেখতে পেয়েছি।
এই ঘৃণ্য কাজগুলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কৌঁসুলির অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে থাকা উচিত। এই জঘন্য কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ায় আমলে নেওয়া উচিত। আমরা যে অন্ধকার গহ্বরের অতলে পতিত হচ্ছি, সেই পতনকে এখনই থামাতে হবে।
আত্মরক্ষার অধিকার সংকুচিত করা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নিরাপত্তা পরিষদের ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর মতো আন্তর্জাতিক নীতিবিরোধী কাজ সভ্য দুনিয়ায় অকল্পনীয়। কিন্তু সেটিই ঘটেছে।
গাজার মাটিতে দাঁড়িয়ে জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন মানবিক কর্মকর্তারা হতাশা প্রকাশ করতে ‘দুনিয়ার নরক’ এবং ‘মানবতা বিদায় নিয়েছে’র মতো বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন। তাঁদের সেই হাহাকার ধ্বনি খুব লোকই শুনেছে বলে মনে হচ্ছে।
পশ্চিমা এবং আরব ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে এখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে। গাজার নারকীয় অবস্থা দেখে পশ্চিমা ও আরব জনগণ তাদের নেতাদের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তাদের দেশের শহরের রাস্তায় রাস্তায় নেতাদের প্রতি ক্রোধে ভরা বক্তৃতা শোনা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে এবং বিশ্বের ছোট ছোট শহরে সেসব বিক্ষুব্ধ ভাষণ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে, কয়েক দশক ধরে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার সেতু নির্মাণের যে প্রচেষ্টা জারি ছিল, তা একেবারে ভেস্তে গেছে।
এ ছাড়া আরব ও মুসলিম বিশ্ব পশ্চিমা মূল্যবোধ ও নীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ—এসবে মুসলিম বিশ্ব এখন আর আস্থা রাখতে পারছে না।
আরব ও মুসলিম বিশ্ব মনে করছে, পশ্চিমারা নিজেই দেখাচ্ছে যে পৈশাচিক পাশবিকতায় তারা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তাঁরা মনে করছেন, যেন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও উদার মূল্যবোধ একসময় আরব বসন্তকে উদ্দীপ্ত করেছিল, সেসব আসলে পশ্চিমা আধিপত্যের হাতিয়ার।
এই অনাস্থা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
● মোহাম্মাদ এলবারাদি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ইমেরিটাস মহাপরিচালক। তিনি আইএইএর সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট