ডান্ডাবেড়ি নিয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন

ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় বাবার জানাজায় অংশ নিয়েছেন ছাত্রদল নেতা মো. নাজমুল মৃধা।

‘আমার ভাই ছাত্রদলের রাজনীতি করার অপরাধে পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় তাঁকে বাবার জানাজায় অংশ নিতে হলো, এর চেয়ে দুঃখের, এর চেয়ে কষ্টের কী হতে পারে? ভাই আমার বাবার কবরে মাটিও দিয়ে যেতে পারল না। প্যারোলের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় শুধু ভাইয়ের জন্য ছোট পরিসরে একটি জানাজার আয়োজন করা হয়েছিল। পরে তাঁকে জেলা কারাগারে পাঠায় পুলিশ।’ (ডান্ডাবেড়ি পায়ে বাবার জানাজায় ছাত্রদল নেতা, প্রথম আলো, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪)

ওপরের কথাগুলো ছাত্রদল নেতা মো. নাজমুল মৃধার ভাই রাসেল মৃধার। তাঁর বাবা মো. মোতালেব হোসেন মৃধা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ছেলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে শনিবার বেলা তিনটার দিকে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম সুবিদখালী গ্রামে বিশেষ জানাজার আয়োজন করা হয়। জানাজার সময় নাজমুলের হাতকড়া খুলে দেওয়া হলেও খোলা হয়নি পায়ের ডান্ডাবেড়ি।

নাজমুল পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর মির্জাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম সুবিদখালী এলাকায় তাঁদের বাড়ির সামনে থেকে তাঁকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।

কারাগারে আটক বন্দীদের এ রকমভাবে ডান্ডাবেড়ি পরানো নতুন কোনো ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের আরও কিছু ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কখনো বাবা বা মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার সময়, আবার কখনো হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থাতেও ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়া হয়নি। ডান্ডাবেড়ি পরানো নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ জেল কোড বা বন্দী আইনের ‘অজুহাত’ দিলেও অনেকেই এগুলোকে ‘অমানবিক’ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলেছেন। মানবাধিকারকর্মীদের কারও কারও মতে, ঔপনিবেশিক আমলের এসব বিধি ও আইন কোনোভাবেই স্বাধীন দেশে প্রযোজ্য হতে পারে না এবং এ ধরনের ঘটনা উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী।

সাম্প্রতিক সময়ে ডান্ডাবেড়ি নিয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর যাঁরা ‘ভুক্তভোগী’, তাঁরা সবাই বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এটা কি কাকতাল, নাকি এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক আছে, এমন প্রশ্নও উঠছে অনেকের মনে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে যদি আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই প্রশ্ন আরও বড় হয়ে দেখা দেবে।

মাসখানেক আগে যশোরের অসুস্থ যুবদল নেতা আমিনুর রহমানকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ পদক্ষেপ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছিলেন আদালত। (যুবদল নেতা আমিনুরকে ডান্ডাবেড়ি পরানো কেন অবৈধ নয়, হাইকোর্টের রুল, ডেইলি স্টার বাংলা, ৪ ডিসেম্বর ২০২৩)।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের পর যশোর জেলা যুবদলের সহসভাপতি ও কলেজশিক্ষক আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে যশোর কোতোয়ালি থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি মামলা করে পুলিশ। ২ নভেম্বর সদর উপজেলার আমদাবাদ কলেজ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর কারাগারে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে প্রথমে যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে এবং পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এ সময়ও তাঁর পায়ের ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। (প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০২৩)

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডান্ডাবেড়ি পরা আমিনুর রহমানের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন গত ২৯ নভেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চের নজরে এনে সুয়োমোটো (স্বতঃপ্রণোদিত) আদেশ চেয়েছিলেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। সেদিন উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে বিচারকেরা বলেছিলেন, জঙ্গি সম্পৃক্ততাসহ হিনিয়াস ক্রাইমের (জঘন্য অপরাধের) ক্ষেত্রে সাধারণত অপরাধীকে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। আমিনুরের বিষয়ে কোনো আদেশ না দিয়ে আদালতের পক্ষ থেকে রিট করার পরামর্শ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৩ ডিসেম্বর সেই রিট আবেদন করার পরের দিন ডান্ডাবেড়ি পরানো কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত।

এর আগে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বিএনপি নেতা আলী আজম কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে মায়ের জানাজায় অংশ নিতে এসেছিলেন। তখন তাঁর ডান্ডাবেড়ি পরে মায়ের জানাজা পড়ার ছবি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। (প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর ২০২২)। মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা এটাকে সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী বলেছিলেন। অন্যদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনাকে ‘অমানবিক’ বলে অভিহিত করেছিল। (প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩)

মাসখানেক যেতে না যেতেই ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি একই রকম আরেকটি ঘটনার ঘটে। এবার শরীয়তপুরে হাতে হাতকড়া আর পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নেন সেলিম রেজা নামের ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা। মায়ের মৃত্যুতে কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেলেও জানাজার সময় তাঁর হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। (প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩)

আলী আজম ও সেলিম রেজাকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনা নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়েছিল। প্রিজনস অ্যাক্ট ও জেল কোডের সংশ্লিষ্ট বিধি ‘স্বেচ্ছাচারী ও অযৌক্তিকভাবে’ ব্যবহার করে সাধারণ বন্দীদের ডান্ডাবেড়ি ও হ্যান্ডকাফ পরানো কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট (‘অযৌক্তিকভাবে’ ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরানো কেন বেআইনি নয়: হাইকোর্ট, প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩)। কয়েক বছর আগেও আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে (এজলাসে) না তুলতেও সতর্ক করে করা হয়েছিল। (আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির নয়: হাইকোর্ট, প্রথম আলো, ১৪ মার্চ ২০১৭)

ডান্ডাবেড়ি পরানো নিয়ে আদালতের রুল ও সতর্কতার পরও কেন একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কারা কর্তৃপক্ষ কি এটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে না? তাহলে কেন এ ধরনের ‘অমানবিক’ ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না?

সাম্প্রতিক সময়ে ডান্ডাবেড়ি নিয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর যাঁরা ‘ভুক্তভোগী’, তাঁরা সবাই বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এটা কি কাকতাল, নাকি এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক আছে, এমন প্রশ্নও উঠছে অনেকের মনে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে যদি আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই প্রশ্ন আরও বড় হয়ে দেখা দেবে।

  • মনজুরুল ইসলাম  প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক