প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২-এর অধীন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। আইনের ধারা ৪(১) অনুযায়ী, ‘অনুসন্ধান কমিটি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ প্রদানের উদ্দেশ্যে আইন অনুযায়ী যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করিবে এবং এতদুদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হইতে নাম আহ্বান করিতে পারিবে।’
এ ছাড়া আইনের ধারা ৪ অনুযায়ী, ‘অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করিয়া দায়িত্ব পালন করিবে এবং এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করিয়া নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করিবে।’
অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে মন্ত্রিপরিষদ ২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যাতে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত দলসমূহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার পদে সুপারিশ করার জন্য অনধিক ১০ (দশ) জনের নাম প্রস্তাব করতে পারবে। ব্যক্তিগত পর্যায়েও আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ নাম প্রস্তাব করতে পারবে।’
উপরিউক্ত বিজ্ঞপ্তিটি দুভাবে আইনের ৪(১) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রথমত, আইনে পেশাজীবী সংগঠনকে নাম প্রস্তাবের জন্য নির্ধারণ করা হলেও প্রজ্ঞাপনে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আইনে না থাকলেও প্রজ্ঞাপনে ব্যক্তিকে নাম প্রস্তাবের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সংসদে পাস করা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আউয়াল কমিশনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা তাদের নিয়োগের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বাধ্য।
আইনের ধারা ৪(৩) অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য অনুসন্ধান কমিটি ১০ জনের নাম প্রেরণ করে, যাঁদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে নিয়োগ প্রদান করেন। আমরা জানি না, রাষ্ট্রপতির কাছে অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করেছে, তাতে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রস্তাব করা কতজনের নাম ছিল। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সংশ্লিষ্ট কমিশন সদস্য ও অন্যান্য সদস্যকে কি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, অন্তত আইনের দৃষ্টিতে একজন অযোগ্য ব্যক্তির সুপারিশে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে?
কেন আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ব্যক্তিপর্যায়ে নাম প্রস্তাবের আহ্বান করা হলো? এটি কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সে সন্দেহ একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আউয়াল কমিশনের নিয়োগের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও আইনের ব্যত্যয় ছাড়াও অনুসন্ধান কমিটির নিরপেক্ষতা গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কমিটির সদস্য ছহুল হোসেন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসরের পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তাই আউয়াল কমিশনের নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
২০১৭ সালে হুদা কমিশনে নিয়োগের সময় শুধু রাজনৈতিক দলের নাম প্রস্তাবের এখতিয়ার ছিল। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তখন ক্ষমতাসীন দল কৌশলের আশ্রয় নিয়ে নিজ শরিক দল এবং সমমনা দলগুলোর মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নাম বারবার প্রস্তাব করিয়ে অনুসন্ধান কমিটির সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রথম আলোর (৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘২০১৭ সালে অন্তত চারটি দল সিইসি হিসেবে কে এম নূরুল হুদার নাম প্রস্তাব করেছিল। দলগুলো হচ্ছে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ ও তরীকত ফেডারেশন, (যদিও ওয়ার্কার্স পার্টি তা অস্বীকার করেছে)। কমিশনার রফিকুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করেছিল পাঁচটি দল—জাতীয় পার্টি (জাপা), জাসদ, সাম্যবাদী দল, তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি)। কবিতা খানমের নাম প্রস্তাব করেছিল আওয়ামী লীগ, সাম্যবাদী দল ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টি।
শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেছিল সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। এর বাইরে মাহবুব তালুকদারের নাম প্রস্তাব করেছিল বিএনপি।’ গত অনুসন্ধান কমিটির সদস্য অধ্যাপক মনজুরুল ইসলামের প্রথম আলোকে (১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) দেওয়া এক সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, ‘নবনিযুক্ত সিইসির নাম সাত-আটটি এবং আলী ইমাম মজুমদারের নাম দুটি দল থেকে এসেছিল।’
এ থেকে প্রতীয়মান হয়, অনুসন্ধান কমিটি সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের সত্যিকারের অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে বের করার পরিবর্তে সবচেয়ে বেশিবার প্রস্তাবিত নামই সুপারিশ করেছিল। এ কারণে নূরুল হুদার মতো যুগ্ম সচিবের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন অপেক্ষাকৃত অচেনা ও সরকারের অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে সিইসি হওয়া সম্ভব হয়েছে।
অনুসন্ধান কমিটি যে মূলত ‘পোস্ট অফিস’-এর ভূমিকা পালন করে, তা জানা যায় আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম এ মতিনের অভিজ্ঞতা থেকে, ‘আমি প্রথম দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগের সার্চ কমিটিতে সদস্য এবং পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনে নিয়োগসংক্রান্ত সার্চ কমিটিতে চেয়ারম্যান ছিলাম...এ ব্যবস্থায় চেয়ারম্যান বা সদস্যদের তেমন কিছুই করার থাকে না। কয়েকটি খামের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দ্বারা সরকারপছন্দ কিছু ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এর বাইরে যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ থাকে না’ (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২২)। অর্থাৎ অনুসন্ধান কমিটির প্রস্তাবিত এ নিয়োগে সর্বোচ্চ বিবেচনাশক্তি বা ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ ব্যবহৃত হয়েছে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে।
যে পরীক্ষিত কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাসীন দল তাদের পূর্বনির্ধারিত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে ২০১৭ সালে নিয়োগ দিতে পেরেছে, এবারও অনেকটা তারই পুনরাবৃত্তি ঘটার অভিযোগ উঠেছে। ‘এবারও নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগের নাম ছিল সরকারঘেঁষা ছোট কয়েকটি দলের তালিকায়। এর মধ্যে তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-বিএসডি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) অন্যতম।
প্রথম চারটি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক। বাকি দুটি দল সরকারঘেঁষা হিসেবে পরিচিত। এ ছয় দলের বাইরেও নবগঠিত ইসিতে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের কারও না কারও নাম একাধিক দল বা ব্যক্তির প্রস্তাবে ছিল...১৪ দলের শরিক ও সরকারঘেঁষা দলগুলোর নেতারা বলেন, তাঁদের মনে হয়েছে, যেসব নাম বেশি দলের তালিকায় এসেছে, সেগুলোই অনুসন্ধান কমিটিতে বেশি বিবেচিত হয়েছে। আগেরবারও এমনটাই হয়েছিল।’ (প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০২২)। সমকালও ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুরূপ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে নূরুল হুদা কমিশনের নিয়োগের পর তরীকত ফেডারেশন দাবি করেছিল যে তাদের সুপারিশ করা তালিকা থেকে সিইসিসহ তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এবারও তাদের দাবি, তাদের প্রস্তাবিত তালিকা থেকে দুজন এবং ২০১৭ সালের তালিকা থেকে আরেকজন কমিশনে নিয়োগ পেয়েছেন (মানবজমিন, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২)। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে এসব অভিনব কৌশল অবলম্বন করার কারণে মন্ত্রিপরিষদের ব্যক্তিপর্যায়ে নাম আহ্বানের বিষয়টি সন্দেহের উদ্রেক না করে পারে না।
এ ছাড়া আইনে স্বচ্ছতার সঙ্গে সততা ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও অনুসন্ধান কমিটি তথ্য প্রকাশে চরম অনীহা প্রকাশ করেছে। ফলে কারা নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়েও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পেতে এই লেখক ব্যর্থ হয়েছেন।
এমনকি তথ্য কমিশনও এ তথ্য প্রকাশের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তাই এটি সুস্পষ্ট, আউয়াল কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম স্বচ্ছতাও প্রদর্শন করা হয়নি, যা আইনের ধারা ৪-এর লঙ্ঘন। ফলে আউয়াল কমিশনের নিয়োগ নিয়ে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
আউয়াল কমিশনের নিয়োগের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও আইনের ব্যত্যয় ছাড়াও অনুসন্ধান কমিটির নিরপেক্ষতা গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কমিটির সদস্য ছহুল হোসেন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসরের পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তাই আউয়াল কমিশনের নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)