‘আপনি কি শান্তি চান? আপনি কি চান জনগণের নিরাপত্তা, চান নিরাপদে থাকুক শিশুরা, সবাই নির্বিঘ্নে কাজকর্ম করুক আর ঘরে ফিরে আসুক স্বজনের কাছে?’ ‘চাই মানে! এই জন্যই তো নিজের জীবন-জীবিকা, আরাম-আয়েশ সব বিসর্জন দিয়ে দেশের সেবা করে যাচ্ছি।’
‘তাহলে আপনারা রাজপথে হানাহানি হয়, এমন কর্মসূচি দিচ্ছেন কেন?’
‘কারণ, দেশের মানুষকে ভালো রাখতে পারি কেবল আমরা! আমরা যদি ক্ষমতায় থাকি বা আসি, তাহলেই দেশের মানুষ ভালো থাকবে। আমাদের যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে বা আসতে হবে। আমরা শান্তি চাই, সেই শান্তি বজায় রাখতে লড়াই চাই।
আমাকে বাদ দিয়ে দেশের মানুষ ভালো থাকবে, তা হবে না। দেশের মানুষকেও ভালো থাকতে হবে, আবার আমাকেও ক্ষমতায় থাকতে বা আসতে হবে।’
‘আপনি ক্ষমতায় নেই, আর দেশের মানুষ ভালো আছে, এ রকমটা যদি হয়!’
‘তা হতে দেওয়া হবে না। দেশের মানুষকে ভালো থাকতে হবে, তবে তার আগে আমাকে ক্ষমতায় থাকতে বা আসতে হবে। আমি ক্ষমতায় থাকছি না, দেশের মানুষ ভালো আছে, এটা কখনো হয় না। দেশের মানুষ ভালো থাকে না। কারণ, আমরাই কেবল দেশপ্রেমিক। আমরাই কেবল সামর্থ্যবান। দেশের মানুষকে ভালো রাখার ক্ষমতা কেবল আমাদের আছে।’
‘না, যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই, আপনি ক্ষমতায় নেই, অথচ মানুষ ভালো আছে। না না, বলছি তো, দেশের মানুষকে ভালো রাখব আমরা! অন্যেরা দেশের মানুষকে ভালো রাখবে না। রাখতে পারছে না। রাখতে পারেনি।’
‘তাহলে শান্তি আসছে না!’
‘আমাদের ক্ষমতায় থাকা বা রাখা মানেই শান্তি!’
এটা একটা কাল্পনিক কথোপকথন। আবার ব্যাপারটা এভাবেও বলা যায়। আমাদের এক দফা: শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়। আমাদের এক দফা: শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন। তারপর দুই পক্ষই নেমে গেল রাজপথে। এ দলের পদযাত্রা, ও দলের শান্তিযাত্রা! পদযাত্রা থেকে বিপদ, শান্তিযাত্রা থেকে অশান্তি। মরে গেল মানুষ। আহত মানুষেরা কাতরাচ্ছে হাসপাতালে। এরপর চলবে গ্রেপ্তার অভিযান। সংবাদপত্রের ভাষায় গণগ্রেপ্তার, আর সেখান থেকে গ্রেপ্তার-বাণিজ্য।
আমরা মনে করি, সরকারের দায়িত্ব বেশি। তাদের নীতি হওয়া উচিত: সংঘাত এড়ানো। নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য করা। এ জন্য বিরোধীদের নির্বাচনে আনা। চুন খেয়ে যাদের মুখ পুড়েছে, দই দিলে তারা আসবে না। কাজেই কাজটা কঠিন। সবাই কি নিয়তির ওপরেই ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে? নাকি রাস্তায় মারামারি করে যাবে? চলবে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তার, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, কর্মসূচি-পাল্টা কর্মসূচি, আগুন? নাকি কোনো আশা আছে।
চলুক। এ দল, বি দল, এ বলে আমি কেবল দেশপ্রেমিক, ও বলে আমি ছাড়া দেশ ধ্বংস, তাদের প্রত্যেকের আছে নিজস্ব যুক্তি, নিজস্ব শক্তি, আছে দল, আছে বিদেশি বন্ধু।
তাদের প্রত্যেকের আছে এক দফা। এদিকে ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে শিশুরা। জিনিসপত্রের দাম গনগন করছে। বাজারে আগুন। টিবিএসের খবর: টাকা ছাপানো হচ্ছে। পড়তে থাকুন:
‘মূল্যস্ফীতির শঙ্কার মধ্যেই টাকা ছাপিয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
মূল্যস্ফীতি অনেক দেশে পড়তির দিকে থাকলেও বাংলাদেশে এই চাপ কমার কোনো লক্ষণ নেই। এর মধ্যেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে টাকা ধার দিতে নতুন টাকা ছাড়ছে, যেটি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি জুলাই মাসের প্রথম ১৮ দিনের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, সরকারি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাজস্ব ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, আদতে ঘাটতি হয়েছে তারও বেশি, প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়ার কারণে বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকার সরবরাহ বাড়াতে হয়েছে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২০ জুলাই, ২০২৩। ’
লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেনের টাঁকশাল। যন্ত্র ঘোরাও, টাকা বানাও। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, টাকা পাচারের রাশ টেনে ধরার কথা কেউ বলছে না। হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপিরা বিদেশে পাচার করছে, বিদেশে পালাচ্ছে। একেকটা হায় হায় কোম্পানি আসে, ই-কমার্সের নামে জনতার টাকা পকেটে পুরে হাওয়া হয়। দেশের মানুষ এত শান্তিতে আছে যে, লোকে আদম ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে হলেও দেশ ছাড়ে, আর ভূমধ্যসাগরের রবারের নৌকায় উঠে মারা পড়ে।
লেখাপড়ার মান তলানিতে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেকে প্রবোধ দেন, দুটো চড়চাপড় দিয়েছে, মেরে তো ফেলেনি, ইন্তেকাল ঘটেনি, সামান্য প্রহার। বিরোধী দলবিহীন উপনির্বাচন বা সিটি নির্বাচনে প্রহৃত বা ধাওয়া খাওয়ারাই তো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। একটা ভাত টিপলে বোঝা যায় সব ভাতের কী অবস্থা, দুটো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাকাল অবস্থা দেখে তো বোঝা যায়, পরিস্থিতি কী রকম আছে, কী হতে পারে! এর মধ্যে দুই পক্ষ নেমে পড়েছে শক্তি প্রদর্শনে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।
তো কথাটা দাঁড়াল, এরও এক দফা। ওর এক দফা। যুক্তরাষ্ট্র কিছু একটা চায়, একবার মনে হয় এটা চায়, আরেকবার মনে হয় সেটা চায়। ইইউ চায়, চায়না কি কিছু চায় না? আর আমাদের মহান প্রতিবেশীরা তো মুখ খোলে না! তাহলে তারা কিছু চায়, কিছু চায় না। তাদের ভাষা বোঝার আশা আমরা ছাড়িনি, বাতাসে ভাসা রাশার ভাষা ভাসা ভাসা নয়, একদম ঠাসা, আর খাসা। তো সবারই ভাষা আছে, কথা আছে, চাওয়া আছে, শুধু জনগণের কোনো দফা নেই, জনগণের কোনো চাওয়া নেই, জনগণের কোনো ভাষা নেই।
অবশ্যটা তর্কের শুরুটা ওইখানেই। জনগণ কী চায়, জানব কী করে? জানার উপায়টা কী? তারা বলবে কীভাবে? চাই স্বাধীন গণমাধ্যম, চাই বাক্স্বাধীনতা, চাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। চাই সমবেত হওয়ার এবং অসন্তোষ প্রকাশের স্বাধীনতা। এবং চাই জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানোর নির্বাচন।
তো নির্বাচন কাছে আসছে। শিল-পাটা ঘষাঘষি শুরু করেছে। মরিচের জান যায় যায়।
একটা সমঝোতায় তো আসতেই হবে। সেটার উদ্যোগ একটা লাগবেই। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৪, ২০১৮-এর নির্বাচন আদর্শ হতে পারে না! তাহলে তো হয়েই গেল। আসুন, নতুন কিছু করি! নতুন কিছুটা কি রাজপথে সমাধান হবে! মরিচ কিনতে পেঁয়াজ ফুরোনো জনগণ কি খেপে গিয়ে পথে নেমে আসবে? নাকি নিজের মোবাইল ফোন, বাচ্চার জিপিএ-৫ নিয়ে আর ৬.৫ প্রবৃদ্ধি নিয়ে নিজের মতোই চলবে!
আমরা নির্বিবাদ মানুষ। বিবাদ চাই না। রাজপথে সমাধান করতে পারবেন তো! করতে গিয়ে জনগণকে মরিচপেষা করবেন? এর উত্তর প্রথম কথোপকথনে!
আমরা মনে করি, সরকারের দায়িত্ব বেশি। তাদের নীতি হওয়া উচিত: সংঘাত এড়ানো। নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য করা। এ জন্য বিরোধীদের নির্বাচনে আনা। চুন খেয়ে যাদের মুখ পুড়েছে, দই দিলে তারা আসবে না। কাজেই কাজটা কঠিন। সবাই কি নিয়তির ওপরেই ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে? নাকি রাস্তায় মারামারি করে যাবে? চলবে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তার, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, কর্মসূচি-পাল্টা কর্মসূচি, আগুন? নাকি কোনো আশা আছে।
ভেতরে-বাইরে কথা হতে হবে। সমঝোতা হতে হবে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা এমন কোনো কঠিন কিছু নয়। বেঁধে দিলেই হলো।
সময়ের ঘণ্টা যোগাযোগ আর সমঝোতার কথাই বলছে। তার সূচনা করার দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদেরই। কারণ, তারা ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীনদের সংঘাতের পথ পরিহার করার চেষ্টা করা উচিত। আর পাবলিক কী করবে। তাদের জন্য থাকল শঙ্খ ঘোষের কবিতা:
হঠাৎ ঝাঁপে উলটে যাবেন
শক্ত হাতে ধরুন
খুব যে খুশি পা-দানিতেই
কেইবা চায় দুঃখ নিতে—
যা পেয়েছেন দেখুন ভেবে
নাক না ওটা, নরুন।
একটু মশাই নড়ুন
ভিতর থেকে নড়ুন
চাপ সৃষ্টি করুন
চাপ সৃষ্টি করুন।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক