নয়াদিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর গত মাসে ভারতীয় অধিকারকর্মী ও বুকার পুরস্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়কে বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের (ইউএপিএ) অধীনে বিচার করার জন্য পুলিশকে অনুমতি দিয়েছেন।
২০১০ সালে কাশ্মীরে যখন অস্থির পরিস্থিতি চলছিল, তখন অরুন্ধতী বলেছিলেন, কাশ্মীর ‘ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ নয়। এর পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই অভিযোগ আনার প্রায় ১৪ বছর পর এখন তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
বেশির ভাগ দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করা অবৈধ। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতপক্ষে বিচ্ছিন্নতা ভারতে একটি বিশেষ উদ্বেগের বিষয়। কারণ, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বিদায় নেওয়ার আগে ভারত ভাগের সময় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখনো শুকায়নি।
ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ইসলামপন্থী পাকিস্তানের সৃষ্ট ঘা এখনো তাজা রয়েছে। সেই ঘা পাকিস্তান ক্রমাগত উসকে দিচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে ভারতীয় ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। মূলত ভারতের কাছ থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করে তা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করার জন্য সেখানকার সন্ত্রাসীদের তারা মদদ দিয়ে যাচ্ছে।
এই পটভূমি মাথায় রেখে বলা যায়, অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্যকে উসকানিমূলক ও অবিবেচনাপ্রসূত—দুটিই বলা যায়। আবার কাশ্মীর দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং তার অকাট্য প্রমাণ আছে বলে যে দাবি করা হয়, তা স্পষ্টত ভুল।
আদতে বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গিয়ে অবাস্তব ও অন্যায্য কিছু দাবি করা অজ্ঞতার পরিচায়ক। আবার যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্যে জনসাধারণ উদ্দীপ্ত হয়, তাঁদের স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিষয়ে বিতর্কিত কোনো কথা উচ্চারণ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
একজন ব্যক্তি ও লেখক হিসেবে আমি রায়কে যতটা প্রশংসা করি, আমি তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধবিচারকে সব সময় ততটা উচ্চ মূল্যায়ন করি না।
অরুন্ধতীর এই বক্তব্য দেওয়া তেমনি একটি ঘটনা ছিল। দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করার অভিযোগ অস্বীকার করে অরুন্ধতী আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন।
ওই সময় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখেছিলেন, ‘আমি যা বলি, তা দেশের প্রতি আমার প্রেম এবং দেশকে নিয়ে আমার গৌরব থেকে আসে।’ তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার আফসোস হয় সেই জাতির জন্য যে তার লেখকদের মনের কথা বলতে দেয় না, তাদের চুপ করিয়ে রাখে।’
অরুন্ধতীর মতো একজন জনপ্রিয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা সম্ভবত সরকারের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। পশ্চিমা বিশ্বে অরুন্ধতী রায় খুবই পরিচিত একটি মুখ। এমনিতেই পশ্চিমে ভারতের বিজেপি সরকারকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেখানে অরুন্ধতীর এই মামলা ভারতের গণতন্ত্রের মানকে আরও নিচে নামিয়ে দেবে।
কেউ তাঁর অনুপ্রেরণাসূচক কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে করুক বা না করুক, ১৪ বছর পর তাঁর মন্তব্যের জন্য তাঁকে বিচার করা হচ্ছে, এটি স্পষ্টই আইনের বাড়াবাড়ি ব্যবহার। এমনকি ২০১০ সালে অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনকে ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল, যদিও তখন তারাই ক্ষমতাসীন ছিল।
তৎকালীন বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অরুন্ধতী রায়ের বিচারের দাবি জানিয়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় সরকার (ওই সরকারে আমি একজন মন্ত্রী ছিলাম) কাশ্মীরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে একটি শান্তি ও পুনর্মিলন সংলাপে যুক্ত ছিল।
সে সময় কংগ্রেস সরকার মনে করেছিল, অরুন্ধতী রায়কে বিচারের মুখোমুখি করা একটি অপ্রয়োজনীয় বিভ্রান্তি ও গোলযোগের সৃষ্টি করবে। অরুন্ধতীর মন্তব্য নিয়ে লোকজনের চিৎকার–চেঁচামেচি শিগগিরই ম্রিয়মাণ হয়ে এসেছিল। ওই সময় ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাঁর বক্তব্যকে আমলে নিয়ে একটি মামলা করেছিল, তবে সেই মামলা আর এগোয়নি।
মূলত সে সময়ের সরকার মনে করেছিল, অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগটি থানার খাতায় টুকে রাখলে তিনি এই বার্তা পেয়ে যাবেন যে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে সরকার একমত নয়। আসলে তিনি যাতে এ ধরনের মন্তব্য ভবিষ্যতে আর না করেন, সেই বার্তা দেওয়ার জন্যই ওই অভিযোগটি নিবন্ধিত করা হয়েছিল। তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ইচ্ছা সরকারের ছিল না।
কিন্তু এখন রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ বদলে গেছে। বিজেপি এখন ক্ষমতায়। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকারের চেয়ে এই সরকারের ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি সহিষ্ণুতা অনেক কম।
মনে হচ্ছে গত নির্বাচনে পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর বিজেপির আগেকার কঠোর অবস্থান থেকে নমনীয় অবস্থানে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
ভারতের ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের পরিবর্তে ইউএপিএ নামের আইনটি মূলত সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই আইনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
অরুন্ধতীর করা মন্তব্যকে এই আইনের আওতায় ফেলে তাঁর বিচার করা হলে সেটি রাষ্ট্রের দিক থেকে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে মনে হয়। কারণ, ১৪ বছর আগে তাঁর কিছু ভুল নির্বাচিত শব্দ রাষ্ট্রের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করে না। এ ধরনের একজন বিশ্বনন্দিত লেখক এবং অধিকারকর্মীকে কিছু ভুল শব্দ প্রয়োগ করার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তোলাটা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অযোগ্যতার মাত্রাই প্রদর্শন করে।
তা ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ভিন্ন মত দমন করার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করা ভারতজুড়ে বাক্স্বাধীনতার গণ্ডিকে আরও সংকুচিত করে ফেলবে। তবে এতে সম্ভবত আমাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এটি সেই সরকার, যারা তাদের মতের বিরোধী সবাইকে ‘দেশবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করে এবং ‘পাকিস্তানের চলে যেতে’ বলে; যেন ভারতে ভিন্ন মত প্রকাশের কোনো স্থান নেই।
এটি সেই সরকার, যারা ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরকে একতরফাভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই রাজ্যটির স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে।
এই বিজেপি সরকার নিয়মিত ভারতকে ‘গণতন্ত্রের মা’ বলে থাকে। কিন্তু তারা মহাত্মা গান্ধীর সেই ভারতে বিশ্বাসী নয়, যেখানে সহিংসতা না ঘটানো যেকোনো বক্তব্য দেওয়াকে অনুমোদন দেওয়া হয়। অরুন্ধতী রায়ের এই মামলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিজেপি ভারতের ভেতরকার তার ভিন্ন মতাবলম্বীদের যে কঠিন বার্তা দিতে চায়, তা হলো মেনে নাও।
তবে অরুন্ধতীর মতো একজন জনপ্রিয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা সম্ভবত সরকারের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
পশ্চিমা বিশ্বে অরুন্ধতী রায় খুবই পরিচিত একটি মুখ। এমনিতেই পশ্চিমে ভারতের বিজেপি সরকারকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেখানে অরুন্ধতীর এই মামলা ভারতের গণতন্ত্রের মানকে আরও নিচে নামিয়ে দেবে।
শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য, যিনি টানা চতুর্থ মেয়াদে লোকসভায় পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ