গ্রামে দুটো দিন কাটিয়ে এলাম। পদ্মা সেতু পার হয়ে বাগেরহাটের ফকিরহাটের বাড়িতে যেতে এখন আর বিশেষ ভোগান্তি নেই। পরিবহনেরও অভাব নেই। এসি, নন-এসি সব ধরনের বাস ঢাকা থেকে দক্ষিণের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাচ্ছে। বাসের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ট্রিপের সংখ্যাও। এ পথে বেড়েছে মাইক্রোবাসের দাপটও। মোটরসাইকেলেও ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে অনেক দূরের পথে চলে যাচ্ছে মানুষ।
যেকোনো কাজে মানুষের স্বস্তি কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত, কাজটি ঠিকমতো সম্পন্ন করতে পারলে। দ্বিতীয়ত, কাজটি সম্পন্ন করতে আর্থিক ব্যয়ের পরিমাণ যৌক্তিক অবস্থায় থাকলে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণের মানুষ ফুড়ুত করে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু এর জন্য আর্থিক ব্যয়ের পরিমাণ এককথায় যথেষ্ট বেশি। কিছু পরিবহন কোম্পানি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে খুলনা বাসভাড়া নিচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। অথচ দূরত্ব মাত্র ২০০ কিলোমিটার।
অবশ্য কম টাকার পরিবহনও আছে। কিন্তু সব সময়ই সাধারণ যাত্রীদের ভাবনায় থাকে, কম টাকার গাড়িতে উঠে কখন জানি কী বিপদ হয়! কখন অ্যাকসিডেন্ট করে গাড়ি গিয়ে পড়ে পাশের খাদে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যাও প্রচুর। তাই আর্থিক সংকটে থাকা মানুষেরাও বাড়তি টাকা ব্যয় করে নিরাপত্তা কিনতে চায়। এ চাওয়ার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই।
একই দূরত্বের গন্তব্যে যেতে কেউ ব্যয় করছেন ৫৫০ টাকা, কেউ ১ হাজার ৪০০। ব্যবধানটা অনেক বেশি নয় কি? অথচ এই বৈষম্য কমানোর কথা কেউ ভাবছেন না। ভাবছেন কি? নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানো একজন যাত্রীর অধিকার। অবশ্যই দ্বিতল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চলতে পারে। তারা বাড়তি ভাড়াও নিতে পারে। কিন্তু তারা যে ভাড়া নির্ধারণ করছে, তা কিসের ভিত্তিতে? পদ্মা সেতুর টোল, এক্সপ্রেসওয়ের টোল রয়েছে। তারপরও তদারক তো করতে হবে কাউকে না কাউকে।
বিজনেস ক্লাস থাকুক, কিন্তু আমাদের দরকার বেশি সংখ্যায় সাশ্রয়ী ভাড়ার ইকোনমি ক্লাসের বাস। কিন্তু ঈদ বা কোনো উৎসব-পার্বণের সময় টিকিট কাটতে গেলে ইকোনমি ক্লাস হাওয়া। এ এক অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার।
২.
যে দুটো দিন ছিলাম, একেবারেই বৃষ্টিমুখর দিন ও রাত। আষাঢ় মাসে এত বৃষ্টি অনেক দিন দেখিনি, বিশেষ করে গ্রামের বাড়িতে বসে। গাছে আম শেষের দিকে। কাঁঠালের এখন ভরা যৌবন। পেয়ারা-আমড়া এখনো কচি। মানুষ উৎপাদিত পণ্য হাটে নিয়ে বিক্রি করছেন, বাজারসদাই করে ঘরে ফিরছেন। চিরায়ত জীবন।
জনজীবনে বিশেষ পরিবর্তন চোখে পড়ল না, কেবল তথ্যপ্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ছাড়া। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ওয়াইফাই সংযোগ। শুক্রবার দুপুরে দুটি শিশু মসজিদের থেকে একটু দূরে কথা বলছিল। তাদের কথা, মুঠোফোনে একটা নম্বর দিয়ে কানেক্ট করলেই ওয়াই–ফাই চলে আসে। জিজ্ঞেস করলাম, ওয়াই–ফাই দিয়ে কী করা যায়? একজন বলল, ফ্রি-ফায়ার (একধরনের গেম) খেলা যায়। আরেকটি ছেলে বলল, ‘ফ্রি-ফায়ার খেললি নিশা হয়ে যায়। তখন মোবাইল থেকে টাকা কেটে রাখে।’ জানতে চাইলাম, তাদের কি নেশা হয়েছে? একজন বলল, ‘আমরা নতুন নতুন খেলতিছি, তাই এখনো নিশা হয়নি।’
নামাজ শেষে বাড়ির দিকে যেতেই লুঙ্গি পরা ওয়াই–ফাই টেকনিশিয়ানের দেখা পাওয়া গেল। সকালে বৃষ্টি ও বাতাসে কিছু কিছু এলাকার লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেছে। গ্রাহকের ফোন পেয়ে টেকনিশিয়ান বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন। তাড়াতাড়ি মেরামতের ফরমাশ আছে!
এই হলো অবস্থা। প্রশিক্ষণের আগেই অস্ত্র হাজির! ছেলেপুলেরা মোবাইল নিয়ে, গেমস নিয়ে পড়ে থাকুক! পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, আশপাশের মানুষ, পরিবেশ, জলবায়ু—কোনো কিছু নিয়ে তাদের আর ভাবনার দরকার নেই। তাদের কোনো কিছু নিয়ে যেন সচেতন হওয়ারও দরকার নেই।
অথচ ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় কত কিছু শেখার ছিল তরুণদের। দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ না করে কেবল অনলাইন গেমসে মজে থাকা!
এত ম্রিয়মানতা, এত আত্মকেন্দ্রিকতা, এতটা নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকা, এমন তরুণসমাজই কি আমরা চেয়েছিলাম? যে বয়সের যে ধর্ম, তা না করে অন্য কিছুতে মন দেওয়ার ফল ভালো হতে পারে না।
তবে এখনো মাঠ থেকে বিকেলবেলা খেলা হারিয়ে যায়নি, অল্পবিস্তর এখনো টিকে আছে, গ্রামের জনসংস্কৃতির এই দিকটি দেখে ভালো লাগল।
এই হলো অবস্থা। প্রশিক্ষণের আগেই অস্ত্র হাজির! ছেলেপুলেরা মোবাইল নিয়ে, গেমস নিয়ে পড়ে থাকুক! পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, আশপাশের মানুষ, পরিবেশ, জলবায়ু—কোনো কিছু নিয়ে তাদের আর ভাবনার দরকার নেই। তাদের কোনো কিছু নিয়ে যেন সচেতন হওয়ারও দরকার নেই।
৩.
দুই দিনে প্রায় আট ঘণ্টা হাটে-মাঠে-ঘাটে কাটিয়েছি। সাধারণ মানুষের কথা শোনার, বোঝার চেষ্টা করেছি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, মানুষজনের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে বিশেষ কোনো আলাপ নেই। অতিসম্প্রতি খুলনাসহ পাঁচ সিটিতে নির্বাচন হয়ে গেল। প্রায় ছয় মাসের মধ্যে আসছে জাতীয় নির্বাচন। এ সময় নির্বাচন, ভোট নিয়ে সাধারণের মুখে খই ফোটার কথা। কিন্তু খই তো দূরের কথা, মানুষ যেন মুখে টেপ লাগিয়ে বসে আছেন।
রাজনৈতিক আলাপ যে একেবারে নেই, তা নয়। আছে নিজ নিজ দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে, তাদের দলীয় অফিসের ভেতরে বা একান্ত নিজস্ব আলাপে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, যাঁরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, কিন্তু রাজনৈতিক চর্চায় আগ্রহী, যাঁরা মানুষ, দেশ, সমাজ নিয়ে ভাবেন, তাঁরা যে আলোচনাটা করতেন, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত।
এই রাজনৈতিক আলাপটা গ্রাম-মফস্সলের মানুষের একধরনের বিনোদনের মতোও ছিল। নব্বই দশকের শুরুতে দেখেছি, চায়ের দোকানে, মুদির দোকানে সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে মুরব্বি গোছের মানুষেরা আড্ডা দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে যুবক বয়সীরাও যোগ দিচ্ছেন। জনপরিসরের সেই আড্ডাটা অনেক দিন ধরেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে ভীত, পাছে কে শুনে ফেলে! বিশেষ প্রয়োজন না হলে তরুণেরা এখন বিকেল-সন্ধ্যায় ঘর থেকেই বের হন না।
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একটা ছেলে বলছিলেন, ‘এখন আর আলোচনা করে কিছু ঠিক হয় না। ওপর থেকে সিদ্ধান্ত আসে। তাঁরা কেবল তা বাস্তবায়ন করেন।’
একজন বলছিলেন, ‘ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও স্থানীয় পাতি নেতারা হস্তক্ষেপ করছেন। কাকে দাওয়াত দেওয়া যাবে, কার নাম বাদ দিতে হবে, তা–ও তাঁরা ঠিক করে দিচ্ছেন!’ কী ভয়াবহ ব্যাপার।
৪.
বিভাজন শেষ করে দিয়েছে আমাদের সমাজ। আর তা পৌঁছে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদেও। মানুষের পাশে মানুষকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না এই বিভাজনের রাজনীতি। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের ইতিহাস তা বলে না।
মানুষ কি পারবে তার শক্তি দিয়ে বিভক্তির রাজনীতি করা কিছু রাজনীতিককে পরাজিত করতে? যাঁরা এই লড়াইয়ে আছেন, তাঁদের জন্য মোহিনী চৌধুরীর চারটি লাইন দিয়ে শেষ হোক এই কলাম: ‘যারা জীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা/ মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা/ সাজি রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি/ বিজয়লক্ষ্মী দেবে তাঁদেরি গলে।’
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]