৫ আগস্টের পর দেশ যখন চরম বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্যের মধ্যে পতিত, তখন সারা দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ত্রাতা হিসেবে সামনে দাঁড়ান। কী অসাধারণভাবে শিক্ষার্থীরা রাস্তাঘাট, সরকারি স্থাপনা, বাজারের ময়লা পরিষ্কার করছেন। ঝুঁকি নিয়ে ভবনের ভাঙা কাচগুলো পরিষ্কার করছেন। পুড়ে যাওয়া ভবনের ছাইভস্ম পরিষ্কার করছেন। রাস্তায় নেমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন। ভবনে ভবনে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন, মন্দির রক্ষায় সামনে দাঁড়াচ্ছেন।
এক অদম্য সাহসী, অকুতোভয় এই তরুণ প্রজন্ম জাতিকে দেখিয়ে দিল তাঁদের সামর্থ্য, সংকল্প এবং দেশ গড়ার প্রেরণা। ওঁরা ময়লা পরিষ্কার করছেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাচ্ছেন, মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছেন—ওঁদের এই অভাবনীয় উদ্যোগ দেখে সবাই অভিভূত। কিন্তু অবচেতনে মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে যে আঁধার ভেদ করে রক্তিম ভোর পেরিয়ে একটি সুন্দর সকাল পেয়েছি—আমরা কি পারব এই সোনালি আলোয় আগামীর পথ চলতে? নাকি আবার কোনো বিষণ্ন মেঘে ঢেকে যাবে আমাদের মুক্তির সকাল।
২০১৮ সালের এই আগস্ট মাসে দেখেছিলাম স্কুল-কলেজের কিশোর শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে রাষ্ট্র মেরামতের কাজে লেগে পড়েছিল। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা রাস্তায় নেমেছিল।
আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল আমাদের ব্যর্থতা, অসততা ও অব্যবস্থাপনা। তাদের লেখা দুটি প্ল্যাকার্ডের কথা খুব মনে হয়, ‘ছাত্রদের আপাতত রাস্তা সামলাতে দিন। মন্ত্রী-পুলিশকে স্কুলে পাঠান শিক্ষিত করতে’ এবং ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’। সে আন্দোলনে সড়কে সাময়িক শৃঙ্খলা ফিরেছিল। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতির ময়লা যখন আমাদের মগজে, তখন যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। দিনে দিনে সড়ক আরও বেশি অনিরাপদ এবং প্রাণঘাতী হয়ে উঠল। মন্ত্রী-পুলিশকে স্কুলে পাঠানো যায়নি এবং রাষ্ট্র মেরামতের কাজও শুরু করতে পারিনি।
এক-এগারো সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন থানায় পুলিশের দল বেঁধে ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ নেওয়ার কথা মনে পড়ে—দুর্নীতি করবে না, ঘুষ খাবে না, জনগণের সেবায় আত্মনিয়োজিত থাকবে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই পুলিশ তাদের অঙ্গীকারের কথা বেমালুম ভুলে গেল এবং রাজনৈতিক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই এক একটি থানা দুর্নীতির আখড়া হিসেবে গড়ে উঠল।
মিথ্যা মামলার ফাঁদে হাজার হাজার মানুষকে বছরের পর বছর হয়রানি, চাঁদাবাজি, মাদক পাওয়ার মিথ্যা নাটক, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জিহাদি বই পাওয়ার অজুহাতে জঙ্গি বলে তুলে নেওয়া—এসব অনাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। এমনকি ঠান্ডা মাথায় ধরে নিয়ে গিয়ে মানুষ হত্যা করে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে জনগণকে মিথ্যা গল্প শুনিয়েছে। ধর্মীয় গ্রন্থ ছুঁয়ে অঙ্গীকারও শেষ পর্যন্ত আমাদের রক্ষা করতে পারেনি। কারণ, ওই যে আমাদের মগজের ময়লা। সবার আগে প্রয়োজন মগজের মেরামত।
আমাদের কোনো বিপ্লবই কাজে আসবে না যতক্ষণ না আমাদের মগজের মজ্জাগত ময়লা দূর করতে পারছি। আমাদের শত শত মেধাবী সন্তানের রক্তের দামে কেনা এই দ্বিতীয় স্বাধীনতাও বৃথা যাবে, তাদের সব আত্মত্যাগ মিথ্যা হবে, দেশ গড়ার সব প্রচেষ্টা বৃথা যাবে যদি আমাদের মগজ ধোলাই না করতে পারি।
তাই প্রশ্ন, মুগ্ধদের মতো কেউ কি আছে বলে বেড়াবে, মগজধোলাই লাগবে কারও, মগজধোলাই? সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে একটি শাস্তি ছিল ‘মগজধোলাই’। মগজধোলাই যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করে মন্ত্র ঢুকিয়ে সব বিরোধী চিন্তা ধোলাই করে দিতে পারত।
অন্তত এ রকম একটি যন্ত্রের আজ খুব প্রয়োজন। আমাদের মগজে জমে থাকা অহমিকা, পরমত-অসহিষ্ণুতা, দেশপ্রেমহীনতা, প্রতিহিংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ-লালসা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির ময়লা ধোলাই করে পরিষ্কার করে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সততা, ন্যায়পরায়ণতার মন্ত্র প্রবেশ করিয়ে এক একজন দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক, খাঁটি মানুষ হিসেবে তৈরি করা যেত।
আমিত্ব, অহমিকা, অহংকার একটি জাতিকে কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে, সে দৃষ্টান্ত এখন আমাদের সামনে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে অনেক স্বপ্ন, অনেক আশার সঞ্চার হয়েছে, কিন্তু আমাদের মগজ তো সেই একই আছে।
এখানেই যত আশঙ্কা, যত ভয়। যতক্ষণ না আমাদের মগজধোলাই হচ্ছে, মেরামত হচ্ছে, মগজের ময়লা পরিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষণ আশা জাগলেও ভরসা পাই না, অন্ধকার দূর হলেও আলো দেখি না। ভয় হয় এক ষাঁড়ের মাথা থেকে অন্য ষাঁড়ের মাথায় তুলে জনগণকে আবার আছাড় দিয়ে ফেলবে কি না।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা এবং জাতীয় আকাঙ্ক্ষা মাথায় রেখে অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো অনেক বিষয়ে সংস্কারের কথা ভাবছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হয়তো সন্ত্রাস এবং অপরাধ নির্মূলে প্রশাসনকে ঢেলে সাজাবেন, পুলিশে পরিবর্তন আনবেন, খুন-গুম-আয়নাঘর বন্ধ করবেন। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হয়তো বেহাল ব্যাংকিং খাতকে হালে তুলে, শুয়ে পড়া শেয়ারবাজারকে জাগিয়ে অর্থনীতির ময়লা সাফ করার চেষ্টা করবেন।
আইন উপদেষ্টা হয়তো বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে, আইনের শাসন নিশ্চিত করে আইনের ময়লা দূর করবেন। কিন্তু আমাদের মূল সমস্যা মগজে, তার কী হবে? সেখানকার ময়লা দূর করার জন্য কোনো উপদেষ্টা আপাতত দেখছি না। কোথায় পাওয়া যাবে, আদৌও পাওয়া যাবে কি না, জানি না।
বর্তমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের নিয়ে একটি জাতীয় সংস্কার কমিশন গঠন করে দেওয়া যায়। তাঁরা বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি করে সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে পারে।
আগামী দিনের বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য দরকারি প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা সেখানে থাকবে। অবশ্য এই কমিশন সে ক্ষেত্রে দুজন অত্যন্ত চৌকস এবং পরিণত মূল সমন্বয়কারীকে মিস করবে। তবে এই কমিশন যেন আমাদের মগজের মেরামত তথা ধোলাইয়ের ব্যাপারটি মাথায় রাখেন।
এই সরকার যত দিন মগজ সংস্কার করতে না পারছেন, তত দিন আশা দেখি না। তাঁরা যত দিন প্রয়োজন সময় নিক। রাষ্ট্রকে একটি মগজধোলাই যন্ত্র বানিয়ে দিয়ে যাক। তাঁরা ভুল করলে আমরা শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে পুরোনো বয়ান ‘আমরাই ক্ষমতায় বসিয়েছি’—এ-জাতীয় আমিত্ববাচক শব্দ মগজ থেকে মুছে ফেলি। পাশাপাশি, যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে শিক্ষার্থীদের রাজপথ থেকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
এটা তো ঠিক ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। যার যা দায়িত্ব তাদের বুঝিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আগামী দিনের পরিচ্ছন্ন মগজের নেতৃত্বে মেধাভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই সময়।
ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]