তাঁহাদের সয়সম্পত্তি-বোঁচকা-বেডিংবিষয়ক কতিপয় হেডিংওয়ালা জবর খবরে গত কয় দিনে সয়লাব হয়ে গেছে দেশ। পাঁচ বছরে কারও সম্পদ হয়েছে ২০ গুণ, কারও ৪০ গুণ। কারও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাকড়ির বাইরে বেড়েছে বাড়ি-গাড়ি-শাড়ি।
কারও গায়ে উঠেছে ১০০ ভরি-২০০ ভরির ভারী গয়না। কেউ কেউ কয়েক কোটি টাকা উপহার পেয়েছেন। টক শো থেকে টকাটক টাকা কামিয়েছেন কেউ কেউ। এগুলো হলফনামার হিসাব।
যেহেতু অভিধানমতে, ‘হলফ’ মানে ‘সত্য বলিবার জন্য ঈশ্বরের নামে দিব্য’; যেহেতু ‘হলফনামা’ মানে ‘যে নথিতে সত্য বলিবার জন্য শপথের পাঠ লেখা থাকে’ এবং যেহেতু হলফনামায় প্রকারান্তরে কিরে-কসম কেটে তথ্য দেওয়া হয়ে থাকে; সেহেতু সেই তথ্যের সত্যতা নিয়ে সংশয় পোষণ মনুষ্যত্বের মধ্যে পড়ে না।
একজন জনসেবক যখন হলফনামায় পই পই করে মাল-সামানার হিসাব দেন, তখন যেকোনো বুঝদার লোক বুঝতে পারেন, সেই জনসেবকের সয়সম্পত্তিতে ঘাপলা থাকতে পারে না। কারণ, হলফনামার হিসাব ‘জাহেরি’ হিসাব।
জাহেরি জিনিস চর্মচক্ষুতে দেখা যায়। মানে, হলফ করে দেখানো হিসাবের মধ্যে ফাঁকিজুকির কারবার থাকার কথা না।
হলফনামায় একজন হলফ করে লিখেছেন, তাঁর পাঁচ কাঠার একটি সরকারি প্লট আছে। সেই প্লটের দাম তিনি দেখিয়েছেন ৪০০ টাকা। তাঁর ৩০ ভরি ওজনের গয়না আছে। তাঁর হিসাবে সেই গয়নার দাম মোট ৪০ হাজার টাকা। মানে প্রতি ভরির দাম এক হাজারও না।
আরেকজন তাঁর হলফনামায় বলেছেন, তিনি ২০ বিঘা জমি কিনেছেন দুই হাজার টাকায়। সে হিসাবে প্রতি বিঘা জমির দাম পড়ে ১০০ টাকা।
‘কারও জন্য পাঁচতলা, কারও জন্য গাছতলা—চলবে না! চলবে না!’ বলে গলা ফাটানো এক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদী নেতা তাঁর হলফনামায় বলেছেন, রাজধানীতে তাঁর মাত্র ১০ কাঠার একটি প্লট আছে।
সাধারণ লোকের অসাধারণ ধারণা, সেই প্লটের দাম কয়েক কোটি টাকা। কিন্তু সেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী বিজ্ঞানসম্মত কায়দায় তাঁর প্লটের দাম দেখিয়েছেন ১৬ লাখ টাকা।
একজন হলফনামায় তাঁর কাছে থাকা সোনার প্রতি ভরির দাম দেখিয়েছেন ১ হাজার ৩৩৩ টাকা।
কারও কারও সম্পত্তির পরিমাণ পাঁচ বছরে ১০০ গুণ বাড়ার পরও দুদক নামক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে কোনো রকম হেলদোল দেখা যায়নি। এখনো যাচ্ছে না। বনের বাঘের সার্কাসের বাঘ হয়ে যাওয়াটা কিছুদিন আগেও যাঁদের কাছে ঘোর বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, তাঁদের সেই বিস্ময় এখন কেটে গেছে। কারণ, তাঁরা ‘দুর্নীতি দমন করি না’র সংক্ষিপ্ত রূপকেই ‘দুদক’ বলে জানতে ও মানতে শুরু করেছেন।
জনসেবকদের এই সব হলফ করা সম্পদনামা দেখে সরল–সোজা যেকোনো লোকের গায়ের লোমের খাড়া না হয়ে উপায় থাকছে না। কারণ, হলফনামায় উল্লেখ করা প্লট, ফ্ল্যাট, গাড়ি, জমি, সোনাদানার যে দাম দেখা যাচ্ছে, তা তার মধ্যে টাইম মেশিনে চড়ে শায়েস্তা খাঁর আমলে ফিরে যাওয়ার ফিলিংস তৈরি করছে। অন্তত ‘খাঁ সাহেবের আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত’—এই তথ্য এখন তার কাছে মোটেও বিরাট ব্যাপার মনে হচ্ছে না।
কারও কারও সম্পত্তির পরিমাণ পাঁচ বছরে ১০০ গুণ বাড়ার পরও দুদক নামক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে কোনো রকম হেলদোল দেখা যায়নি। এখনো যাচ্ছে না। বনের বাঘের সার্কাসের বাঘ হয়ে যাওয়াটা কিছুদিন আগেও যাঁদের কাছে ঘোর বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, তাঁদের সেই বিস্ময় এখন কেটে গেছে। কারণ, তাঁরা ‘দুর্নীতি দমন করি না’র সংক্ষিপ্ত রূপকেই ‘দুদক’ বলে জানতে ও মানতে শুরু করেছেন।
যেহেতু জনসেবকেরা ‘ঈশ্বরের নামে দিব্য’ দিয়ে ‘হলফনামা’ পেশ করেছেন, সেহেতু ইমানদার ভোটারদের পক্ষে নেতাদের কিরে-কসম কেটে পেশ করা তথ্যকে অসত্য ঠাওরে পাপী হওয়ার স্পর্ধা দেখানো সম্ভব হচ্ছে না।
তবে কিনা সর্ববিষয়ে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বাঙালির চিরায়ত প্রশ্নরোগ আছে। জাহেরি হিসাবে তাদের পোষায় না। তাই এই সমাজসেবকদের বাতেনি সম্পদের বিষয়েও তাদের কৌতূহল খুব একটা কম না।
এই দুষ্ট প্রকৃতির সন্দেহবাতিকগ্রস্ত সম্প্রদায় মনে করে, এক কোটি টাকার জিনিসকে এক হাজার টাকার জিনিস দেখিয়ে যে জনসেবক হলফনামা দেন, তাঁর মধ্যে ঝামেলা আছে। তারা মনে করে, যাঁর জাহেরি সম্পদের মধ্যেই এত ঘাপলা, না জানি তাঁর বাতেনি সম্পদ কত।
মানুষের চিন্তায় নাওয়া–খাওয়া ভুলতে বসা এই মহান রাজনীতিকদের পয়সাকড়ির খবর পড়ে তাঁদের নিয়ে এই দুষ্ট লোকেরা মাঝে-সাঝেই আজেবাজে কথা বলে। তারা বুঝতে চায় না, জনসেবকদের বিষয়বুদ্ধি মুৎসুদ্দির চেয়ে টনটনা থাকতে হয়। সব দিক সামাল দেওয়ার মতো ডাইনামিক হতে না পারলে তাঁরা কিসের জনপ্রতিনিধি?
মানুষের কষ্টের কথা ভাবার পাশাপাশি তাঁদের নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা ভাবতে হয়। মাছের ঘের, বালুমহাল, টক শো ইত্যাদি থেকে পয়সা কামাই করার কথা ভাবতে হয়।
জাতি যাতে স্বামী হিসেবে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ তুলতে না পারে, সে জন্য এই জনসেবকদের অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজের স্ত্রীর গয়না ও সম্পদ অন্তত ১০ গুণ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হয়।
নেতাদের এই ‘টু ডু লিস্ট’ যারা বোঝে না, তারা ‘অশিক্ষিত, মূর্খ, ছোটলোক, গরি... ই... ই... ব।’
এই জনসেবকদের চক্রবৃদ্ধি হারে সম্পদ বাড়ানোর মনোরম দৃশ্যে যাদের চোখ টাটায়, তাদের জন্য পার্টির পক্ষ থেকে ছটাক খানিক করুণামিশ্রিত অবজ্ঞা তোলা থাকল।
২.
মহাভারতে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে দ্রুতগামী কী? যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, ‘চিন্তাই সর্বাপেক্ষা দ্রুতগামী’।
পরিতাপের বিষয়, আমাদের এমপি-মন্ত্রীদের হলফনামা আর তাঁদের মাল কামানোর গতি জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব দেখেননি। দেখলে তিনি তাঁর উত্তরটিকে তিনি আরও নিখুঁত করতে পারতেন।
যাকগে, ধর্মকথা বলে লাভ নেই। কারণ, অনেকে ‘না শোনে ধর্মের কাহিনি’।
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক