২৫ বছর আগের একদিন। সাবেক সিইসি সাঈদ সাহেব অনাসৃষ্টিকারীদের লিস্টি হাতে মিষ্টি করে বলেছিলেন: ‘দুষ্টু লোকেরা পালিয়ে গেছে’। যৌথ বাহিনীর সেই কাহিনির স্মৃতি ঝালিয়ে নিলে দেখা যাবে, সে বছর ‘দুষ্টু লোকেরা’ আদতে পালিয়েছিল না। আসলে তারা তলিয়েছিল। তাড়া খেয়ে গাড়ার মধ্যে টুপ করে ডুব দিয়েছিল। তারপর টাইমমতো ভুস করে মাথা জাগিয়েছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গে গঙ্গার অতল জল বহু দূর গড়িয়েছে। এখন আবার দুষ্টুদের পলায়ন-পর্ব শুরু হয়েছে। একদিকে পুরোনো দুষ্টু পালাচ্ছে, অন্যদিকে হাটে-মাঠে-বাঁটে এসেছে নতুন দুষ্টু; তাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে স্থান।
বুখারেস্ট আন্দোলনকারীরা ‘প্যালেস অব পার্লামেন্ট’ ঘিরে ফেলার পর হেলিকপ্টারে করে পালাতে গিয়ে নিকোলাই চসেস্কু ধরা পড়লেও ৫ আগস্টের হেলিকপ্টার গণভবন থেকে ফাঁক বুঝে ঠিকঠাক উড়ে গেছে। পাত্র-মিত্র-মন্ত্রী-যন্ত্রী-সেপাই-সান্ত্রি সব ফেলে তিনি গেলেন গজিয়াবাদের ঘাঁটিতে।
তারপর থেকে চলছে ক্ষমতা খোয়ানো খালু-খালা-শালী শালার পালানোর পালা। কেউ কেউ পালাতে পেরেছে। কেউ কেউ এখনো পারছে। কেউ কেউ বর্ডার ঘেঁষা পগার পার হতে না পেরে অপার হয়ে ‘পারে লয়ে যাও আমায়’ গাইছে।
যাঁরা ধরা পড়বেন বলে ধরা হচ্ছিল, পরে দেখা গেল তাঁদের মধ্যে ম্যালা চ্যালাব্যালাসহ ‘খ্যালা হবে’ খ্যাত এক নেতা দিল্লির নিজাম আউলিয়ার দরগায় সিন্নি বিলাচ্ছেন। গোটা রাষ্ট্রকে ‘স্ব-রাষ্ট্র’জ্ঞান করা এক লোককে কলকাতার ইকোপার্কে আড্ডা দিতে দেখা গেল।
সেই পার্কে আর কে ছিল? ছিল ওকালতি না করা অমুক উকিল, আর তাঁর বউ তমুক উকিল। পাবলিকের কিল এড়াতে খালি উকিল দম্পতি না, রাম-শ্যাম-যদু-মধুর মতো নানক-নাছিম-হাছান-তাজুল, মহিবুল ছাড়াও আরও যেন কারে কারে ‘ওপারে’ দেখা গেছে।
আরাফাতের ময়দানও দেশ থেকে অনেক দূরে। ‘পালাব না, প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাড়িতে গিয়ে উঠব’ বললে কাদের কথা মনে আসে? সেই তারাও দেশ ছেড়ে গেছেন। অন্যদিকে, সংসদ ভবনের গ্র্যান্ড এরিয়ার বাসা থেকে ‘কারা ওরা? কোত্থেকে এল?’খ্যাত নেতার রোলেক্স-গুচি ব্র্যান্ডের বহু ঘড়ি, জুতো, স্যুট লুট হয়ে গেছে।
এর আগে এয়ারপোর্টে এক পলকে একজন এবং অনেকে ধরা পড়েছেন। সীমান্তে একজন জাস্টিস মব জাস্টিসের মুখে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। একজন সীমান্ত পার হওয়ার পর দুর্বৃত্তের মারে পরপারে চলে গেছেন। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে বহু লোক চলে গেছে। এদের কারও নামে মামলা ছিল, কারও নামে ওয়ারেন্ট ছিল। দেশ ত্যাগে কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সবাই বলছে, ‘তারা দেশেই ছিলেন, তাহলে তারা কেমন করে দেশের বাইরে গেলেন?’
২.
এই প্রশ্নটা এখন বেশ বড় হয়ে উঠছে। যাঁরা দেশ ছাড়ছেন বলে খবর আসছে, তাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা আছে। তাদের অনেকের পাসপোর্ট লক করে দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা দেশ ছাড়তে পারছেন কেমন করে?
এই প্রশ্ন গুরুতর। এর জবাবের সঙ্গে দেশের পুলিশ, গোয়েন্দা, ইমিগ্রেশন সিস্টেম, সর্বোপরি সীমান্ত-সার্বভৌমত্বের বিষয় জড়িয়ে আছে।
একের পর এক মামলার আসামিদের বিদেশে চলে যাওয়ার খবর যখন বের হচ্ছে, তখন পুলিশের দিক থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তিনি দেশ থেকে বৈধভাবে বাইরে যাননি। অন্য কোনোভাবে ম্যানেজ করে গেছেন। ‘ইমিগ্রেশন পার হলে আমাদের কাছে প্রমাণ থাকবেই। তাদের ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ নেই।...অনেকেই অবৈধভাবে গেছেন। কেউ দেশে আছেন।’ —এসবি প্রধানের এই কথাকে হালকা কথা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
দেখা যাচ্ছে, সিলেট, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ (হালুয়াঘাট), যশোর অঞ্চল, লালমনিরহাটসহ উত্তরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশ গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বেশি। এ জন্য জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে সীমান্তের দুই পাশের দালালদের। দালালদের এই টাকা দিলেই যে তারা ঠিকঠাক পৌঁছে দেবে, সে গ্যারান্টিও নেই। অনেক সময় দালালেরা এসব লোকের কাছ থেকে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে।
এর আগে ১৮ আগস্ট আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তি থেকে আমরা জেনেছিলাম, বিভিন্ন সেনানিবাসে ৬২৬ জন আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে তাঁদের মধ্যকার অল্প কয়জন ছাড়া প্রায় সবাই নিরাপদ বোধ করায় সেনানিবাস ছেড়ে চলে গেছেন। আর এখন প্রায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে কারও না কারও দেশ ছাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এসব খবরে পাবলিকের মনে হচ্ছে, এই আসামিরা এখনো প্রভাবশালী। হয় তাঁরা প্রভাব খাঁটিয়ে নয়তো কোনো মহলের সঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকায় আপস রফা করে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। জনমনের এই ধারণা সাংঘাতিক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। ব্যাপকভাবে যদি এই ধারণা জনমনে গেঁথে যায়, তাহলে তারা এই সিদ্ধান্তে আসবে যে, হয় পতিত সরকারের এসব নেতাদের ঠেকানোর মতো ক্ষমতা এই সরকারের নেই, নয়তো তাদের টাকার কাছে কেউ কেউ বিক্রি হয়ে গেছেন।
এই দুটো ধারণাই সরকারের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। পাবলিক যদি ধরে নেয়, এই সরকার আপসকামী বা এই সরকারেও পয়সা খাওয়া লোক আছে, তাহলে চলমান ছোট ছোট দাবি নিয়ে জড়ো হওয়া আন্দোলন বড় হতে থাকবে। সে আন্দোলন সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক