এই ‘গণদুর্নীতি’র কারণ কী, সমাধানই বা কীসে

দেশে আসার পর গত মাসে প্রথম বিউটি পারলারে গিয়েছি। রাজধানীর ধানমন্ডিতে স্বনামে পরিচিত পারলার।

ব্রাইট নারিশিং ফেসিয়াল, পেডিকিউর-ম্যানিকিউর আর হেয়ারফল ট্রিটমেন্ট মিলে ছয় হাজার টাকার বিল এল। ভেতরটা তখন খচখচ করছে। এতগুলো টাকা মাত্র দুই ঘণ্টায় রেখে যেতে হবে!

সেই সঙ্গে অনুধাবন করলাম, গত আড়াই বছরে পারলারের সেবার মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মনে মনে ভাবছি, চারদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ে এত হাহাকার, নিশ্চয়ই এদের গ্রাহকসংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে।

কিন্তু পারলারের নতুন সুন্দর ও বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র দেখে আমার ধারণা সঠিক হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। আর তখনই আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমার পাশেই দাঁড়ানো একজন ভদ্রমহিলা তাঁর মেয়ের জন্য ১২ হাজার টাকা পে করলেন।

বুঝলাম, দেশে এক শ্রেণির মানুষের হাতে এখন অনেক টাকা। আর এসব সৌন্দর্যসংশ্লিষ্ট বিলাসী সেবা এখন আমাদের মতো মধ্যবিত্তের কাছে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ক্রিকেট বলের মতো, দেখলেও ক্যাচ ধরার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন

আমার এই চিন্তার রেশ কাটতে না কাটতেই সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির শৈল্পিক চিত্র প্রকাশিত হতে থাকল।

সাবেক পুলিশপ্রধান থেকে শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য বিদায়ী সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অপর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দুর্নীতি, কিংবা নামকরা অ্যাগ্রো ফার্মের দাম হাঁকানোর ক্যারিশমা যেন এক নান্দনিক উপন্যাসের রোমাঞ্চকর অধ্যায়।

দেশের পরিস্থিতি এখন এমন যে দুর্নীতির দক্ষতাকে সূচক হিসেবে ধরে নিয়ে তারা ১০০ মিটার দৌড়ে প্রতিযোগিতা লিপ্ত হয়েছে, কে কত কম সময়ে অপরকে ছাড়াতে পারে, সেটাই মূল লক্ষ্য।

সারা দেশ আজ দুর্নীতির মহামারিতে আক্রান্ত, যা করোনা মহামারির চেয়েও ভয়াবহ। প্রতিটি সেক্টরে বিরামহীনভাবে দেশপ্রেম আর সততার লাশ দাফন হয়ে চলেছে। বুঝলাম, দ্রব্যমূল্য বা সেবার মূল্য কেন এমন গগনচুম্বী।

প্রশ্ন হলো আমরা যারা এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎ ব্যক্তির দান অবলীলায় গ্রহণ করছি, সামান্য অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাদের প্রধান অতিথি করে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছি, কে কত টাকা দান করল সেটা প্রচার করছি, তারা কি এই দুর্নীতিকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছি না?

কারণ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা খরচের সময়ে মানুষ নিজের পকেটে কয়টা জোড়া পড়েছে সেই হিসাব করে না; তারা মাছের বাজারে দর-কষাকষি করে না; পণ্যের গুণগত মানের চেয়ে অর্থমূল্য এদের কাছে মুখ্য বিষয়; তারা দুই হাতে অর্থ দান করে একটা শ্রেণিকে সারা জীবনের জন্য পরনির্ভরশীল করে রাখে।

তাদের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের মানদণ্ড বৈধ উপার্জনের ওপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে দান করা অর্থের অঙ্কের ওপর।

গত কয়েক দিনে একেকজনের দুর্নীতির যে সাতকাহন উঠে এসেছে, তা দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কথা মনে পড়ল। তারা যেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি। বাংলাদেশ এই কর্মকর্তাদের জন্য অস্থায়ী কর্মস্থলমাত্র।

অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকা হলো তাঁদের স্থায়ী আবাস, নিজ জন্মভূমি। তাঁদের পরিবারের একটি অংশ থাকে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে, সেখানে তারা আয়েশি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। আর নিজেরা দেশের মাটি নিংড়ে, গরিবের রক্ত শুষে অর্থ পাচার করতে থাকেন শেষজীবন আরামে কাটানোর জন্য। তাঁদের কাছে ঢাকা-টরন্টো বিমানভ্রমণ যেন ঢাকা-ফরিদপুর সড়কপথে ভ্রমণের মতোই।

আরও পড়ুন

সুযোগ পেলেই অবকাশযাপনের জন্য পরিবারের কাছে ছুটে চলে যান। নিজের হারাম রোজগারের বিনিময়ে কানাডা-আমেরিকার রাস্তায় হালাল খাবার খুঁজে বেড়ান। মানুষ কতটা দ্বিচারী হলে নিজেরে অবৈধ রোজগার দিয়ে সন্তানদের কানাডার মতো দেশে বসবাসের ব্যবস্থা করেন, যেখানে অবৈধভাবে জীবনযাপনের সুযোগ নেই, যেখানে কেউ বাবার পরিচয়ে রাস্তায় বের হয় না, হসপিটালে আলাদা সেবার সুবিধা পায় না কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষ বিবেচনায় ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করতে পারে না।

অথচ তারা নিজেরা যদি সৎ কর্মকর্তা হতেন, বাংলাদেশও ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর মতো সুন্দর এবং নিয়মের দেশ হতো। আফসোস!

নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যদি বাদ দিই, গত কয়েক মাসে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তাদের যেসব ছবি ভাইরাল হয়েছে, তাতে তাঁদের মধ্যে একটি কমন বিষয় লক্ষণীয়।

আপাতদৃষ্টে তাঁরা প্রত্যেকে অত্যন্ত ধর্মভীরু, সৃষ্টিকর্তার ওপর আস্থাশীল। যদিও কোনো ধর্মই অসৎ পথের রোজগারকে অনুমোদন করে না, তাঁরা তাঁদের অবৈধ সম্পদ অর্জনকে সৃষ্টিকর্তার মহিমা হিসেবে প্রচার করতে সিদ্ধহস্ত; বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে মুক্তহস্তে দান করেন।

শারীরিক পরিশ্রম করতে সক্ষম সুস্থ ব্যক্তিদেরও দান করে পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করতে নিরুৎসাহিত করেন। এতে ধীরে ধীরে তাঁদের ওপর নির্ভরশীল একটি শ্রেণি তৈরি হয়, যাদের কাজই হলো নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্তুতি করা।

প্রশ্ন হলো আমরা যারা এ ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎ ব্যক্তির দান অবলীলায় গ্রহণ করছি, সামান্য অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাদের প্রধান অতিথি করে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছি, কে কত টাকা দান করল সেটা প্রচার করছি, তারা কি এই দুর্নীতিকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছি না?

নিজের অসততাকে জাস্টটিফাই করার জন্য যাঁরা ধর্মকে কলুষিত করছেন, আমরা কি তাঁদের সামাজিকভাবে বর্জন করেছি? নতুন কারিকুলাম আসার আগপর্যন্ত স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিক শিক্ষার পাঠ বাধ্যতামূলক করেছি? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপরিউক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর হলো, ‘না, আমরা করতে পারিনি।’ তাহলে কি এই দায় আমাদেরও নয়?

আরও পড়ুন

বিদ্যমান প্রথম শ্রেণির চাকরির মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় চাকরি হলো বিসিএস ক্যাডারভুক্ত চাকরি। সরকারি চাকরি সম্পর্কে জ্ঞান আছে, এমন যেকোনো ব্যক্তিমাত্রই জানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করার পর কি প্রাণপণ যুদ্ধ করে এই চাকরি অর্জন করতে হয়।

আমি ধরে নিচ্ছি দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের মধ্য থেকে এই সিলেকশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা একজন গ্র্যাজুয়েটের হাতে অবাধ অর্থ আর অপরিসীম ক্ষমতা তুলে দেওয়ার আগে রাষ্ট্রের বিবেচনায় নেওয়া উচিত যে একজন মেধাবী দুর্নীতিবাজ অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী দুর্নীতিবাজের চেয়ে দুর্নীতিতে বেশি পারদর্শী হবে।

মেধা ভালো, যদি সেটা ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়। মেধা ও অসততার যোগফল মানবজাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর তার প্রমাণ পারমাণবিক বোমা, বিভিন্ন যুদ্ধবিমান। একইভাবে রাষ্ট্র যাঁদের ওপর দেশের মানুষের দায়িত্ব দিয়েছিল, তাঁরা নিজেরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের গ্র্যাজুয়েটদের সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারছে না কিংবা রাষ্ট্র তাদের অফিসারদের সঠিকভাবে সৎ অফিসার হওয়ার ট্রেনিং দিতে পারছে না। এই দায় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যাবে কীভাবে?

একটা সময় দেশের মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল বিটিভি। বিটিভির বেশির ভাগ নাটকের মূল উপজীব্য ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার। সেসব নাটকের নির্মাণ ও ডায়ালগ এত শক্তিশালী ছিল যে খুব সহজে সৎ ও অসৎ মানুষের জীবনযাপনের পরিণতি ফুটে উঠত।

সেই সময়ে প্রতিটি গ্রাম বা মহল্লায় কয়েকটি বনেদি মধ্যবিত্ত পরিবার থাকত, যাদের মূল সম্বল ছিল পারিবারিক মূল্যবোধ বা সদ্‌গুণ। ধীরে ধীরে সেই পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গা যৌনটা, অর্থ, ব্র্যান্ড দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মূল উপজীব্য হলো যৌনতা, অপরাধ ও অর্থ। ওটিটি বা ইউটিউবে পণ্যের প্রদর্শনী এমনভাবে হয় যে অনুকরণীয় প্রজন্ম সেই পণ্যের দিকে সহজেই আকৃষ্ট হয়।

এই কন্টেন্টগুলোতে শিক্ষার গুরুত্বকে হাইলাইট করা হয় না, নৈতিকতা বা মূল্যবোধকে হাইলাইট করা হয় না, বরং হাইলাইট করা হয় তারকাদের ব্যবহৃত বস্তুগত পণ্য, অপরাধের ক্যারিশমা। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ তৈরিতে এই কনটেন্টগুলোর নির্মাণশৈলীর এই রূপান্তরও অনেকাংশে দায়ী।

দুর্নীতির এক প্রত্যক্ষ কারণ হলো আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নামে আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে ছেলেখেলার পর্যায়ে নামিয়ে নিয়েছি। একদিকে প্রতিবছর হাজার হাজার বেকার তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষা বিশ্বমানের হচ্ছে না।

রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করা কিংবা দুর্নীতিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা উভয়ই অপরাধ। আর সেই অপরাধের সঙ্গে আমরা প্রতিটি নাগরিক কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। নদীতে যেমন সময়মতো বাঁধ না দিলে তা সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তেমনি এই মুহূর্তেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে এই দেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

  • নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা

ই-মেইল: [email protected]