ট্রাম্প হারলেও ট্রাম্পবাদ থেকে যাবে

ডোনাল্ড ট্রাম্প

ইউভাল নোয়া হারারি তাঁর নেক্সাস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইনফরমেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম দ্য স্টোন এজ টু এআই বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমরা নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারি না, যেসব সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্তি ছড়ায়, তারা সব সময়ই ব্যর্থ হতে বাধ্য।’ আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এ বক্তব্যের গুরুত্ব স্পষ্ট। রিপাবলিকান পার্টির রাজনৈতিক শাখায় পরিণত হওয়া ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) আন্দোলনটি একটি বিভ্রান্তিকর আন্দোলন। এর নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তিনি যদি আবার ক্ষমতায় আসেন, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।

এই বাস্তবতা প্রায় সবাই জানেন। তারপরও জরিপগুলো ট্রাম্পের প্রায় ৫০ শতাংশ জনসমর্থন দেখাচ্ছে। উগ্র, আপত্তিকর, উদ্ভট এবং স্পষ্টতই বিপজ্জনক বক্তব্যের জন্য ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠার পরও এই ফলাফল দেখা গেলে তা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। ‘মাগা’ আন্দোলনের মানুষকে মোহগ্রস্ত করে নিজের দিকে টানার ক্ষমতা আছে।

এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, আমেরিকার অর্ধেক ভোটার মনে করেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের চেয়ে বেশি উপযুক্ত।

ট্রাম্প-সমর্থকদের প্রত্যেকেই হয়তো ট্রাম্পকে সমর্থন করার পেছনে একই কারণ দেখাবেন না; কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটি সাধারণ মিল রয়েছে। সেটি হলো, তাঁরা সবাই ডানপন্থী প্রচারণার প্রবল প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে মোহগ্রস্ত হয়ে আছেন।

এসব ভোটার এক দশক ধরে ট্রাম্পের এমন সব উদগ্র ও বিষাক্ত বক্তব্য শুনে আসছেন, যা কিনা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ মাত্র। আমেরিকানরা প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রয়াত রাশ লিম্বোর (প্রভাবশালী আমেরিকান রেডিও ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থী চিন্তাধারা প্রচার করতেন) ঘৃণামূলক কথাবার্তা শুনেছেন এবং প্রায় ৩০ বছর ধরে ফক্স নিউজের একঘেয়ে মুখগুলোকে মিথ্যা ছড়াতে এবং বিভেদ উসকে দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকান নেতাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এখন ট্রাম্প নামক দানবটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে ‘কনজারভেটিভ’ আন্দোলন তাদের সর্বনিকৃষ্ট প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটানোর প্ল্যাটফর্ম পেয়ে গেছে। রক্ষণশীল মিডিয়ায় ট্রাম্প স্থায়ী মঞ্চ পেয়ে গেছেন।

২০১৫ সালে ট্রাম্প যখন ট্রাম্প টাওয়ারের সেই ‘স্বর্ণালি’ এসকেলেটরে নেমে আসেন এবং তাঁর প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার ঘোষণা দেন, তখন দেখা যায়, যাঁরা ডানপন্থী মিডিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছেন এবং এর সুবিধা ভোগ করেছেন, তাঁরা ট্রাম্পের দ্বারা সমালোচিত, অবহেলিত ও অপমানিত হচ্ছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের সমর্থকেরা তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে রয়েছেন।

অর্থাৎ ট্রাম্পের উত্থান কনজারভেটিভ আন্দোলন ও মিডিয়ার গতিপথে একটি মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। একদিকে প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকানরা নিজস্ব অবস্থান হারাচ্ছেন, অন্যদিকে ট্রাম্পের রাজনৈতিক স্টাইল ও ব্যক্তিত্ব তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

২০১৬ সালে মূলত আমেরিকার তথ্যজগৎকে কবজা করার মাধ্যমে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন। সে সময় তিনি ও তাঁর সঙ্গে উঠে আসা মাগা রাজনীতিকেরা ডানপন্থী প্রচারমাধ্যমে প্রায় সীমাহীন সম্প্রচার সময় পেয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য যতই অযৌক্তিক বা অদ্ভুত হোক না কেন, সে বক্তব্যকে স্বাভাবিক বলে প্রচার করা হয়েছিল। এমনকি এসব বক্তব্যের ‘সত্যতা’র প্রশংসাও করা হয়েছিল।

শুধু কনজারভেটিভ মিডিয়াই ট্রাম্পের দিকে জনসাধারণের দৃষ্টি স্থির রেখেছিল, তা নয়। ‘যদি হানাহানি হয়, তাহলে সেটিই প্রধান খবর’—নিউজ রিপোর্টিংয়ের এই মৌলিক নীতি অনুসরণ করে প্রথাগত মিডিয়া ট্রাম্প ও তার মাগা আন্দোলনের রাজনৈতিক বিভাজনের ওপর নিয়মিত খবর প্রকাশ করেছে।

তখনকার সিবিএস টেলিভিশন চ্যানেলের চেয়ারম্যান লেস মুনভেস ২০১৬ সালে বলেছিলেন, ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ‘আমেরিকার জন্য ভালো নয়’, কিন্তু তাঁকে এয়ারটাইম দেওয়া ‘মিডিয়া কোম্পানির জন্য খুব ভালো’। ডানপন্থী মিডিয়ার সাফল্য অনুকরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বামপন্থীরা। ডানপন্থীরা তাদের উদ্দেশ্য প্রচারে যেকোনো পদ্ধতি অবলম্বনের যে প্রবণতা দেখিয়েছে, বামপন্থীরা তেমনটা করেনি।

উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই প্রগতিশীল চিন্তার উর্বর ভূমি নয়। বামপন্থী প্রতিষ্ঠানের অভাব ডানপন্থী মিডিয়াগুলোকে এমন ধারণা ও নীতি প্রচারের সুযোগ করে দিয়েছে, যা আমেরিকান জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় নয়। নির্বাচনী দৃষ্টিকোণ থেকে রিপাবলিকান প্রচারকারীরা ইতিমধ্যেই ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ভোটারদের প্রায় অর্ধেকের কাছে অবিশ্বস্ত করে তুলতে পেরেছে।

এমনকি যারা ডেমোক্র্যাটদের সুযোগ দিতে ইচ্ছুক, তারাও ছোটখাটো ত্রুটি খুঁজে দেখছে, যা রিপাবলিকানদের দীর্ঘদিনের প্রচারিত আতঙ্কের বার্তাকে সত্যি বলে প্রমাণ করতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, এটাই কি ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট হবে কি না। যদি ভোটাররা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে আমেরিকা কিছুটা সময় পাবে। কিন্তু তা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। কারণ, পরবর্তী চার বছরে মাগা মিডিয়া আরও কট্টর, বিশৃঙ্খল ও নিয়ন্ত্রণহীন হবে এবং তারা কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে অবিরাম আক্রমণ চালাবে।

রিড গ্যালেন দ্য লিংকন প্রজেক্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ