বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক একটি বিশেষ গুরুত্ববাহী ও বহুমুখী বিষয়, যা দুই দেশের ইতিহাস, ভূগোল ও সংস্কৃতির গভীর যোগসূত্রে প্রোথিত। ঐতিহাসিকভাবে এ সম্পর্ক বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সমর্থনের বহু দৃষ্টান্ত থাকলেও সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ঘটনাগুলো বারবার এ সম্পর্ককে নাড়া দিয়েছে এবং এগিয়ে যাওয়ার পথকে জটিল করে তুলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এ সন্দেহ ও অবিশ্বাসকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি দুই দেশের সম্পর্কের ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে। এর ফলে ন্যায্যতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে একটি টেকসই ও আস্থাভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
সম্পর্কের ভিত্তি: ন্যায্যতা ও বহুমাত্রিকতার প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে ভারত সরকারের পাশাপাশি সেখানকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবর্তনকে নির্মোহ ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করা এবং জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। এ মূল্যায়ন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক হওয়া উচিত নয়; বরং তাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একটি বহুমাত্রিক, গভীর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
তবে দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা, পতিত স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন, ভুল তথ্য উপস্থাপন এবং অতিরঞ্জিত খবর প্রচার একটি নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এর কারণে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জটিল হচ্ছে। ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে সাম্প্রতিক হামলা এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। এটি একটি নিন্দনীয় ঘটনা, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ভারত সরকারকে অবশ্যই দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশেরও উচিত ভারতের সঙ্গে ন্যায্যতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপনে মনোনিবেশ করা। এ প্রেক্ষাপটে দুই দেশের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়, যেমন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ভাগাভাগি, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ, পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহজীকরণ এবং আন্তদেশীয় যোগাযোগ উন্নত করার মতো বিষয়ে সমাধানের পথ যৌথভাবে অনুসন্ধান করা জরুরি।
বাংলাদেশ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এটাও গুরুত্বপূর্ণ যেন তারা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কিংবা প্রতিবাদে সস্তা ভারতবিরোধিতার জায়গা তৈরি না করে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও পরিপক্ব অবস্থান গ্রহণ করাই বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষায় অপরিহার্য। কারণ, সস্তা ভারতবিরোধিতা অনেক সময় কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর তাৎক্ষণিক স্বার্থে উপযোগী হতে পারে; কিন্তু এটি কখনোই বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে সহায়ক নয়।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা: অভিন্ন চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ একটি বাস্তব ও গভীরভাবে প্রোথিত সমস্যা, যা উভয় দেশের সমাজ ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান। দুই দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে বৈষম্য, নিপীড়ন ও অধিকার সংকুচিত হওয়ার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। এ ধরনের বৈষম্যের অবসানে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ও সুপরিকল্পিত নীতি নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি। তবে এ সমস্যা প্রায়ই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে, যা প্রকৃত সমাধানের পথকে জটিল করে তোলে এবং মূল সমস্যার শিকড়কে স্পর্শ করে না।
উভয় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান চাহিদা হলো সমান অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন। তারা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থের হাতিয়ার হতে চায় না। এ বাস্তবতা মাথায় রেখে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হওয়া উচিত।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে এমন যেকোনো গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সতর্ক থাকা আবশ্যক, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে। এ ধরনের গোষ্ঠীগুলো শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে না; বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়লে তার প্রভাব ভারতের অভ্যন্তরে প্রতিফলিত হতে পারে এবং একইভাবে ভারতের পরিস্থিতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে প্রভাবিত করতে পারে।
এটি একটি বাস্তবতা যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো উভয় দেশে অসহিষ্ণুতা ও বিভাজন উসকে দেয়। তারা কেবল নিজেদের দেশে সমস্যার সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং একে অপরকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করে। এ প্রেক্ষাপটে উভয় দেশের সরকারের দায়িত্ব হলো এসব গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়; নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় নেতাদেরও এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উভয় দেশের নেতৃত্বকে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হয়। একই সঙ্গে তাদের জন্য এমন একটি মানবিক, সহিষ্ণু ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলা আবশ্যক, যেখানে সবাই নিজস্ব পরিচয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারে।
এ ধরনের সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ কেবল সংখ্যালঘুদের জন্যই নয়; বরং দুই দেশের সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ যে তারা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি উদাহরণ স্থাপন করতে পারে, যা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়ক হবে।
নতুন সম্ভাবনার সুযোগ কাজে লাগানো
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ন্যায্যতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে একটি বহুমাত্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সময়ের অপরিহার্য দাবি। ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির গভীর আন্তসম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এ সম্পর্ককে আরও টেকসই ও গতিশীল করার মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের আর্থসামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি কেবল প্রয়োজনীয় নয়; বরং দুই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী পরিস্থিতি দুই দেশের রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি পুরোনো কৌশল, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। একই সঙ্গে এটি একটি নতুন ও ইতিবাচক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সম্ভাবনা উন্মোচনের সুযোগ তৈরি করেছে।
এখন সময় এসেছে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় উভয় পক্ষের উচিত ন্যায্যতা ও পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর যৌথ সমাধান খুঁজে বের করা। যদি এ সুযোগ যথাসময়ে কাজে লাগানো না হয়, তবে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো এই ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করার চেষ্টা করবে। এ ধরনের গোষ্ঠী উভয় দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বে বাধা সৃষ্টি করে।
তাদের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড সমস্যাকে সমাধানের পরিবর্তে আরও জটিল করে তোলে, যা উভয় দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। তাই বাংলাদেশ ও ভারতের উচিত একটি নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা। কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, সুশীল সমাজ, শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব রয়েছে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করার। এটি শুধু দুই দেশের মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরিতেই সহায়ক হবে না; বরং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর অঞ্চলের জন্য শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের একটি উদাহরণ স্থাপন করবে।
উভয় দেশের নেতৃত্বের উচিত দূরদর্শী ও বাস্তবমুখী নীতির মাধ্যমে জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। সংকীর্ণতা ও একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে আন্তরিকতা, পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নয়; বরং উভয় দেশের জনগণের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার পথ সুগম করবে।
সেলিম রায়হান অর্থনীতির অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম