লুটপাটের মাধ্যমে অতি দ্রুত অকল্পনীয় রকম টাকা বানানো বাংলাদেশের নব্য ধনীদের কাছে সুইস ব্যাংক অতি পছন্দের নাম। ব্যাংকটিতে বর্তমানে বাংলাদেশিদের ‘মাত্র’ ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা জমা আছে। এটি আসলেই ‘মাত্র’, কারণ এই অঙ্ক এ দেশ থেকে প্রতিবছর পাচারকৃত মোট টাকার ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি হবে না।
দুর্নীতি ও টাকা পাচার হাত ধরাধরি করে চলে, তাই গত কয়েক বছরে টাকা বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়েছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) জানিয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৯৬৬ কোটি ডলার, যা বর্তমান ডলারের মূল্যে সাড়ে ৯ লাখ কোটি টাকার বেশি; অর্থাৎ প্রতিবছর পাচার হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এই প্রতিষ্ঠান শুধু আমদানি (ওভার ইনভয়েসিং) ও রপ্তানির (আন্ডার ইনভয়েসিং) মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচারকৃত টাকার হিসাব দেয়। অর্থাৎ এর সঙ্গে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার যুক্ত করলে মোট পাচারকৃত টাকার অঙ্ক হবে প্রায় দ্বিগুণ।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকা মূল্য হারাচ্ছে অতি দ্রুত। এর অন্যতম প্রধান কারণ লেনদেনের ভারসাম্যের সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে আসা। গত অর্থবছরে দেশের আমদানি ডলারের অঙ্কে আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ (২৫ বিলিয়ন ডলার)। করোনায় মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের ভোগ অনেক কমে গেছে নিশ্চয়ই, যা আমদানির পরিমাণকে অনেক কমিয়ে দেওয়ার কথা। ওদিকে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে কিছু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, বেড়েছে জাহাজভাড়া। এ দুই বিষয় বিবেচনায় নিলেও দেশে আমদানির পরিমাণ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এতটা বৃদ্ধির একটাই ব্যাখ্যা—বিরাট অঙ্কের টাকা পাচার।
অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে, টাকা পাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে বলছে এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলছেন। আমি বরং প্রশ্ন করি, এই সরকারের আমলে কারা টাকা পাচার করছে? সরকারি দলের লোক বা তাদের অনুগ্রহভাজন ছাড়া কারও পক্ষে কি টাকা পাচার সম্ভব? সরকারের সমর্থন ছাড়া কি তারা এসব করতে পেরেছে? সরকার কেন পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে দেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অথচ একই সময়ে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতটির কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৫৮ শতাংশের বেশি, যা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের এক সুস্পষ্ট প্রমাণ। খতিয়ে দেখলে এমন প্রমাণ মিলবে আরও নানা ক্ষেত্রেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে, টাকা পাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরও দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ টাকা পাচার হচ্ছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে বলছে এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলছেন। আমি বরং প্রশ্ন করি, এই সরকারের আমলে কারা টাকা পাচার করছে? সরকারি দলের লোক বা তাদের অনুগ্রহভাজন ছাড়া কারও পক্ষে কি টাকা পাচার সম্ভব? সরকারের সমর্থন ছাড়া কি তারা এসব করতে পেরেছে? সরকার কেন পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে?
টাকা পাচারকারীদের প্রতি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হচ্ছে টাকা পাচারকে অস্বীকার করা। ২০২১ সালের ৭ জুন সংসদে টাকা পাচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমি যখন অর্থমন্ত্রীর কাছে জবাব চেয়েছিলাম, তখন অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন, আমাদের দিন।’ এর আগে ২০১৭ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বাস্তবে এটি মোটেই অর্থ পাচার নয়। সাংবাদিকেরা ‘অত্যন্ত অন্যায়ভাবে’ বিষয়টিকে পাচার বলছেন। তবে কিছু অর্থ পাচার হয়; সেটি অতি যৎসামান্য। এটা নজরে নেওয়ার মতোই নয়’। সর্বশেষ গত ১০ জুন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি।’
এর মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কিছু কাজও করে থাকে, তাহলেও সেটার ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। দেশে ও দেশের বাইরে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) জানায়, বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত করে গত পাঁচ অর্থবছরে ১ হাজার ২৪টি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে অর্ধেক ঘটনায় দেশের বাইরে অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে।
বিএফআইইউ যেসব ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে, তার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার (যেমন দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক) কাছে পাঠিয়েছে। তবে তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও এসব ঘটনায় কোনো সংস্থা এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা যায়নি। এ ছাড়া পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে এসেছে ৮৪ জনের নাম। টাকা পাচারকারী হিসেবে যাদের কারও বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।
ওদিকে সরকার পাচারের তথ্য ধামাচাপা দিতেও ভীষণ সচেষ্ট। জিএফআই টাকা পাচারের হিসাবের জন্য ব্যবহার করে জাতিসংঘে দেশগুলোর দেওয়া আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত ডেটা। প্রতিষ্ঠানটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে অন্য সব দেশের ক্ষেত্রে হালনাগাদ ডেটার ভিত্তিতে তথ্য দিলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা পারেনি। তারাই জানিয়েছে, ২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘে আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত ডেটা দেয়নি। কেন সে ডেটা দেওয়া হয়নি, তার কারণ বোঝা নিশ্চয়ই ‘রকেট সায়েন্স’ নয়।
সুইস ব্যাংকের ক্ষেত্রেও আছে একই পরিস্থিতি। বাংলাদেশ সরকার আদৌ চায়নি সেই ব্যাংক থেকে পাচারকারীদের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে। ২০১৭ সাল থেকে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) নামক কাঠামোর আওতায় নিজ দেশে কর ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে তার তথ্য দিতে বাধ্য থাকে সুইস ব্যাংকগুলো। এ কাঠামোতে স্বাক্ষরকারী ১২১ দেশের মধ্যে ভারত, মালদ্বীপ, এমনকি পাকিস্তান থাকলেও নেই বাংলাদেশ। স্বাক্ষর না করার কারণও কি খুব স্পষ্ট নয়?
সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সেই আশা আমরা কেন করি!
রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী