বিশ্ববিদ্যালয় আইনের গণতান্ত্রিক সংস্কার জরুরি

বাংলাদেশে এখন ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত কাগজে–কলমে আছে। বিগত দুই দশকে জেলায় জেলায় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বেশ কিছু বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ না করেই শিক্ষার্থী ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পরিবেশ তো সৃষ্টি করা যায়ইনি; বরং এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়েও রয়েছে গুরুতর প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার নিয়ে, মোটাদাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা নিয়েই বেশ কিছু কাজ করার সুযোগ আছে।

সেই প্রসঙ্গ আপাতত ঊহ্য রেখেও বলা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে এবং আইনগতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করা হয়েছে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়। এসব বিশ্ববিদ্যালয় আইনগতভাবেই যেহেতু প্রশাসক তথা ভিসিনির্ভর, তাই প্রশাসকের স্বেচ্ছাচারিতার বহু নমুনা আমরা দেখতে পাই। উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতির অভিযোগও পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য বন্ধ করে উদার, গণতান্ত্রিক ও মুক্তচিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার করা প্রয়োজন। ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান সেই সুযোগ এনে দিয়েছে

নিজেদের বোঝার সুবিধার্থে আমরা প্রায়ই যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩-এর আইন বা অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলছে, তাদের ‘স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়’ বলি, আর বাকিগুলোকে বলি ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়’! যদিও এ ধরনের কোনো বিভাজন অন্তত কাগজে–কলমে নেই। ‘স্বায়ত্তশাসিত’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নানাভাবে দলীয়করণসহ সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করেছে, এ আলোচনা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই। কিন্তু এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বাদবাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা যে আরও শোচনীয়, প্রান্তিক অবস্থানের কারণেই বোধ হয় সে বিষয় আলোচনায় সেভাবে আসে না।

যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করা দরকার ছিল, সেখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইনগতভাবেই আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাঁদের মতামত প্রদানের জায়গাগুলোকে সংকুচিত করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলো পর্যালোচনা করে আমাদের সামনে এ চিত্রই ফুটে ওঠে।

আমাদের দেশের মুক্তিসংগ্রাম ও এর পটভূমি প্রস্তুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। সেই বাস্তবতায়, ১৯৭৩ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনে যে পরিবর্তন আনা হয়, তা শতভাগ স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল কি না, সে বিতর্ক এড়িয়েও বলা যায়, সেই নতুন আইনগুলো সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিবাচক ছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জনগণের মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, নতুন রাষ্ট্রে ও সমাজে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও হয়ে উঠবে আরও পরিণত, হয়ে উঠবে মুক্তবুদ্ধিচর্চার কেন্দ্র এবং অধিকতর গণতান্ত্রিক। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো।

আমরা দেখি, ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। সেই আইনে ৭৩-এর অধ্যাদেশে ভাইস চ্যান্সেলর প্যানেল নির্বাচন বাদ দেওয়া হয়, সিনেট বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে না, ডিন নির্বাচনের বিধান থাকে না, ভাইস চ্যান্সেলরের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করা হয়, শিক্ষকদের চাকরির শর্ত কঠিন করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর ১৯৮৭ সালে পাস হয় দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাবিপ্রবির আইন।

এ আইনে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো মোটাদাগে বহাল তো ছিলই, উপরন্তু চ্যান্সেলরকে আরও ক্ষমতাবান করতে এবং শিক্ষার্থী-শিক্ষককে ‘বাধ্যগত’ করতে আরও আরও ধারা যুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশের আইনে সিন্ডিকেটও প্রতিস্থাপিত হয় রিজেন্ট বোর্ড দ্বারা, যে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্যদের একটা বড় অংশই থাকে সরকার কর্তৃক মনোনীত, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও নিরঙ্কুশ হয়।

আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ৭৩-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইনগুলো আমরা দেখি, সেখানে চ্যান্সেলর ভাইস চ্যান্সেলরকে নিয়োগ দেন সিনেটে নির্বাচিত তিন সদস্যের একটি প্যানেল থেকে। সিনেটে শিক্ষক-ছাত্র-রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটের প্রতিনিধি থাকায় ভাইস চ্যান্সেলর নির্বাচনে শিক্ষক-ছাত্রদের মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সেখান থেকে সরে আসা শুরু হয়। এ আইনের ১০–এর ১ ধারায় বলা আছে, ‘চ্যান্সেলর যে শর্তাবলী নির্ধারণ করিয়া দিবেন, সেইমতো তিনি চার বৎসরের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগ করিবেন।’

সুতরাং রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ বিধানের পর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, তার আইনে দু-একটি শব্দের হেরফের করে রেখে দেওয়া হয়েছে। ‘গণতান্ত্রিক’ বলে পরিচিত সরকারগুলো এর কোনো পরিবর্তন আনেনি, আইনের এই ধারাকে তারা রেখে দিয়েছে। ১৯৯৮ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে আরও যুক্ত করা হয় যে ‘উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, চ্যান্সেলরের সন্তোষানুযায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ (১০-এর ২ উপধারা, বশেমুকৃবি আইন)।

বলাবাহুল্য, এরপরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ক্ষেত্রে ধারাটি রেখে দেওয়া হয়। এ আইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরও পাকাপোক্ত হয় এবং ‘চ্যান্সেলরের সন্তোষানুযায়ী’ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে ভাইস চ্যান্সেলর বাধ্য থাকেন। একদিকে নিয়োগ যেহেতু হচ্ছে চ্যান্সেলরের মাধ্যমে এবং টিকেও থাকতে হচ্ছে ‘চ্যান্সেলরের সন্তোষানুযায়ী’, সুতরাং ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার দৌড়ে এবং ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে টিকে থাকতে মুখ্য যোগ্যতা হয়ে পড়ছে সরকারের তোষণ। আবার চ্যান্সেলরের সন্তুষ্টি থাকলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ভাইস চ্যান্সেলরই সর্বেসর্বা, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার কোনো দায় নেই উপাচার্যের।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের আরেকটি যে ধারার কথা বলা যেতে পারে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের কোন সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবের সাথে ভাইস-চ্যান্সেলর একমত না হইলে, তিনি সেই সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বন্ধ রাখিতে পারেন এবং রায়ের জন্য চ্যান্সেলরের নিকট তাহা পাঠাইতে পারেন এবং সেই ব্যাপারে চ্যান্সেলরের রায় চূড়ান্ত হইবে।’ (১১–এর ৮ উপধারা, ইবি আইন)। এ ধারাই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনে একটু ভাষাগত পরিবর্তন করে টিকে আছে।

অথচ ‘স্বায়ত্তশাসিত’ বলে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধারায় চ্যান্সেলর নয়, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আবার সিন্ডিকেট যেহেতু সিনেটের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, সেখানে কিছুটা সুযোগ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেকহোল্ডাদের মতামত প্রতিফলিত করার। অপর দিকে আইনগতভাবেই ‘সরকারি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের মতের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বডির কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব নেওয়া কার্যত অসম্ভব। রাষ্ট্রও এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণও স্থাপন করতে সক্ষম হয়।

শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতির ব্যাপারেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বলা হয়েছে, ‘উচ্ছৃঙ্খলতা, অযোগ্যতা, কর্তব্যে অবহেলা, অসদাচরণ, অদক্ষতা, নৈতিক অধঃপতনের’ কথা। শিক্ষকদের ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’, ‘অসদাচরণ’ কিংবা ‘কর্তব্যে অবহেলা’ কিসে হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করাকে প্রশাসন যদি ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’, ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য করে কিংবা আন্দোলনের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলে তা যদি ‘কর্তব্যে অবহেলা’ হয়, তাতে শিক্ষকেরা শাস্তি পেতে পারেন, এমনকি তাঁর চাকরিও চলে যেতে পারে। এত কিছুর পরও চ্যান্সেলরকে আরও ক্ষমতাবান করতে শাবিপ্রবির আইনে একটি ধারা যুক্ত করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেও যুক্ত হয়।

সেই ধারার অর্থ হলো, চ্যান্সেলর চাইলে কিংবা তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে বলে ‘প্রতীয়মান’ হলে তিনি যেকোনো আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবেন, যা মানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সবাই বাধ্য। (১০–এর ৪ উপধারা, শাবিপ্রবি আইন)। সুতরাং রাষ্ট্রের কোনো নীতির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান নিতে চাইলে চ্যান্সেলরের আদেশে তা বেআইনিও হয়ে যেতে পারে! সুতরাং একধরনের সামন্তবাদী চর্চার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে, বেতনভুক সরকারি কর্মচারীর মতো কেবল পাঠদান করা এবং মাস শেষে বেতন নেওয়াই শিক্ষকদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য বন্ধ করে উদার, গণতান্ত্রিক ও মুক্তচিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার করা প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অংশীজনদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াও অত্যন্ত জরুরি।

  • অভিনু কিবরিয়া ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়