দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজকের মতো এতটা তীব্র জ্বালানিসংকট বিশ্বে আর দেখা যায়নি। ইউক্রেনে রাশিয়ার নৃশংস আগ্রাসন এবং এর ধারাবাহিকতায় ক্রেমলিন ও পশ্চিমাদের মধ্যে শুরু হওয়া ভূ-অর্থনৈতিক যুদ্ধে জ্বালানি গ্যাসের বিশ্ববাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। এতে গ্যাসের দাম অভূতপূর্ব বেড়ে গেছে, এমন নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। গ্যাস ও তেলসমৃদ্ধ রাশিয়া জ্বালানিকে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে ইউরোপ রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং আসন্ন শীতে যাতে বড় ধরনের গ্যাসঘাটতির মুখে না পড়তে হয়, সে জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে জ্বালানির আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি ও সরবরাহব্যবস্থা ওলট–পালট হয়ে পড়েছে।
বিশ্বে কোনো দেশই এই প্রভাব এড়াতে পারেনি। এমনকি যেসব দেশ আগে থেকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, তারাও পারেনি। এর দৃষ্টান্ত পাকিস্তান। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান গ্যাস আমদানির জন্য বেশ কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছিল। কিন্তু সেই চুক্তি ভঙ্গ করে সরবরাহকারীরা যেসব দেশ বেশি দাম দিচ্ছে, তাদেরই গ্যাস সরবরাহ করছে। জ্বালানি কিনতে উন্নত ও উন্নয়নশীল—সব দেশের কোষাগার খালি হয়ে যাচ্ছে।
এই ফাঁকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে ক্রেমলিন নিজেদের অর্থনীতি টেকসই করতে বৈশ্বিক জ্বালানির এই সংকটকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ইউক্রেনে নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো পশ্চিমা প্রতিরোধকে ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাশিয়া প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
সম্প্রতি ইউরোপকে চেপে ধরার জন্য গ্যাসের সরবরাহ আরও কমিয়ে দিয়েছে রাশিয়া। নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে গ্যাসের সরবরাহ সামর্থ্যের ২০ শতাংশ কমিয়ে দেয় মস্কো। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানিমন্ত্রী আসন্ন শীতে ১৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার কমানোর আহ্বান জানান।
এ ঘোষণার মাধ্যমে ইউরোপ প্রমাণ করতে চায়, রাশিয়ার চাপে তারা মাথানত করছে না এবং ইউক্রেনকে একা ফেলে রেখে যাচ্ছে না। চাহিদা কমানোর উদ্দেশ্য থেকেই এ সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেটা নিশ্চিতভাবেই মন্দার মতো পরিস্থিতি তৈরি করছে। গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণার পর বিশ্লেষকেরা বলেছেন, শীতের আগে ইউরোপ ৮০ শতাংশ গ্যাস মজুতের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা পূরণ হবে না।
যদিও ইউরোপ দেরিতে হলেও স্পষ্ট একটা অবস্থানে এসেছে। সেটা হলো, গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা যেকোনো মূল্যে বন্ধ করা। যত দিন রাশিয়ার ওপর এই নির্ভরতা থাকবে, তত দিন পর্যন্ত ক্রেমলিন ইউরোপকে যতটা সম্ভব যন্ত্রণা দিয়ে যাবে।
বিশ্বে সর্বশেষ দেখা দেওয়া জ্বালানিসংকটের সময় ইউরোপ ও এর মিত্রদের হাতে তেলের বাজারের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ে ব্রিটিশ সরকার পেট্রোলিয়াম যুদ্ধসংক্রান্ত বিভাগ এবং পেট্রোলিয়াম বোর্ড গঠন করেছিল। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালে জ্বালানির সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য সব মিত্রদেশের জ্বালানি সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনা হয়েছিল।
জার্মানিতে করা সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৫৮ শতাংশ মানুষ জার্মানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। এই সংখ্যা যাতে ক্রমাগত কমে যায়, সেই কাজই করে যাচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর উদ্দেশ্য হলো জনসমর্থনটা যেন এতটা কমে যায়, যাতে ইউক্রেনকে সহায়তা করার নীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় জার্মানি। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে যে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তাতে জনসমর্থন হারাতে হচ্ছে ইউরোপের সরকারগুলোকে।
ইউরোপকে এখন একই সঙ্গে তিনটি কঠিন কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ঘাটতি গ্যাস দিয়ে শিল্পোৎপাদন অব্যাহত রাখা, ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা করে যাওয়া এবং জীবন-জীবিকার সংকটের মুখেও রাশিয়াকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ওপর জনসমর্থন টিকিয়ে রাখা। রাশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যকার চলমান ভূ-অর্থনৈতিক যুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি গুরুত্বপূর্ণ একটি লড়াইয়ের ক্ষেত্র। ইউরোপকে এখন জ্বালানিতে নিজেদের শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এ জন্য ইউরোপের সরকারগুলোকে অনিবার্যভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু জ্বালানির সরবরাহ-ঘাটতির যে সমস্যা, সেটা তড়িঘড়ি করে সমাধান করতে গেলে উল্টো ফল ফলতে পারে।
বিশ্বে সর্বশেষ দেখা দেওয়া জ্বালানিসংকটের সময় ইউরোপ ও এর মিত্রদের হাতে তেলের বাজারের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ে ব্রিটিশ সরকার পেট্রোলিয়াম যুদ্ধসংক্রান্ত বিভাগ এবং পেট্রোলিয়াম বোর্ড গঠন করেছিল। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালে জ্বালানির সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য সব মিত্রদেশের জ্বালানি সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনা হয়েছিল।
আজ বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থার মালিকানা আরও বহুমুখী। সে কারণেই শীত আসার আগেই জ্বালানি খাতে বিশ্বের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা ও ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলোকে একত্রে বসে একটা কৌশল প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সুযোগগুলো হেলায় হারানো হচ্ছে।
গত জুনে জি-৭ সম্মেলনে গ্যাস উৎপাদনে চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়েছেন নেতারা। আসছে নভেম্বর জি-২০ সম্মেলনে জ্বালানিক্ষেত্রে বড় কোনো অগ্রগতি হবে, এমনটা আশা করা যায় না।
তবে ইউরোপীয় নেতাদের সামনে একটি সুযোগ রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ইতালির মিলানে গ্যাসটেক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জ্বালানিমন্ত্রী এবং শিল্প খাতের নির্বাহীরা থাকবেন। এর পরপরই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। জ্বালানি কূটনীতির সুযোগ কাজে লাগাতে হলে এখন থেকেই প্রস্তুতি দরকার।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
● ম্যাক্সিমিলান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চের ফেলো