শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে (২০০৯-২৪) দুর্নীতি, লুটপাট ও দখলদারির পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ছিল উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো একটি বিষয়। ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া—এগুলো ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। বিরোধী দল ও মত দমনের জন্য ‘গায়েবি’ মামলায় গ্রেপ্তার এবং সাজা দেওয়ারও অনেক ঘটনা ঘটেছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী রূপ প্রকাশিত হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালে এসে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনের চেষ্টা করতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত একটি অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছেন।
কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অল্প সময়ের মধ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা সহজ কাজ নয়। কারণ, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর পুরোনো কাঠামো, তাদের কাজের পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায়নি।
গণ–অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরই মধ্যে সরকারের বয়স চার মাস পেরিয়ে গেছে। মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এখন তাই প্রশ্ন করাই যেতে পারে, এ সরকারের আমলে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হলো কিংবা মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ কতটা কাটল?
এ ক্ষেত্রে দুটি সিদ্ধান্তের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে সাধুবাদ জানানো যেতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর এবং এ বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করা। আরেকটি হলো বহুল আলোচিত-সমালোচিত সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া।
গুম নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের পর আমরা আশা করি, বাংলাদেশে আর কোনো গুমের ঘটনা ঘটবে না কিংবা কোনোভাবে ঘটলেও সেগুলোর যথাযথ তদন্ত, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। অপর দিকে সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য কাউকে আর জেল-জুলুমের শিকার হতে হবে না—এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এসব ইতিবাচক পরিবর্তনের পরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরোনো প্রবণতা বহাল থাকার মতো দৃষ্টান্ত লক্ষ করা গেছে। ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের ঘটনা না ঘটলেও যৌথ বাহিনীর অভিযানে মৃত্যুর অভিযোগ এসেছে। সম্প্রতি এ রকম ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যশোর সদর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানকালে নির্যাতনে ৩ ডিসেম্বর যুবদল নেতা আতিক হাসান সরদার (৩৯) ও ৬ ডিসেম্বর দুবাইপ্রবাসী হযরত আলী (২৭) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। উভয় পরিবারের দাবি, তাঁদের গাছের সঙ্গে বেঁধে ও ঝুলিয়ে অমানসিকভাবে পিটিয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানেই তাঁদের মৃত্যু হয়।’ (প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪)
এ সরকারের আমলে গত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত এ রকম আরও আটটি মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। (নিউ এজ, ১৬ নভেম্বর ২০২৪)। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন করে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত এসব ঘটনার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি।
এ সরকারের আমলে এখন পর্যন্ত গুমের ঘটনা না ঘটলেও নিরাপত্তা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক তুলে নেওয়া ও নির্যাতনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি এ রকম একটি ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাতে সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় নিজ বাসা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটির সাভার থানা প্রতিনিধি জুলকারনাইনকে তুলে নিয়ে যায় যৌথ বাহিনী। পরে তাঁকে সাভার মডেল থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরদিন বেলা ১১টার দিকে থানা থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তুলে নেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে জুলকারনাইন বলেন, ‘গতকাল রাতে (শুক্রবার দিবাগত রাত) আমাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। আমরা এ দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, অধিকারের জন্য আন্দোলন করি। কেন আমাকে রাতের আঁধারে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাকে ডাকলেই আমি তাদের ডাকে সাড়া দিতাম। আমাকে কিছু শারীরিক নির্যাতনও করা হয়।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪)
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক তুলে নেওয়া ও নির্যাতনের পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি প্রচলিত পদ্ধতি হলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাউকে মামলার আসামি বানিয়ে হয়রানি করা। ৫ আগস্টের পর এ রকম ঢালাও মামলা করে মামলা–বাণিজ্যের বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এ ধরনের মামলা–বাণিজ্য করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।
কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন, একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অল্প সময়ের মধ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করা সহজ কাজ নয়। কারণ, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর পুরোনো কাঠামো, তাদের কাজের পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায়নি।
তাঁদের যুক্তির যথার্থতা মেনে নিয়েও বলতে হচ্ছে, সরকার বা নীতিনির্ধারকদের কাজ হবে এসব ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তনের সূচনা করা; রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ করা। আমরা যদি কার্যকরভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে হয়তো আর কখনো স্বৈরাচারের উত্থান ঘটবে না।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক