২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের মতে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন এবং তিনি এটিকে মডেল নির্বাচনে পরিণত করতে চান। বলা বাহুল্য, নির্বাচনটিকে ‘মডেল’ করতে হলে সেটিকে হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?
গাজীপুর সিটিতে আগে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ২০১৩ সালের ৬ জুলাই রকিবউদ্দীন কমিশনের অধীনে। আর দ্বিতীয়টি হয়েছে ২০১৮ সালের ২৭ জুন হুদা কমিশনের তত্ত্বাবধানে। প্রথমটি ছিল সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তথা মডেল নির্বাচন এবং দ্বিতীয়টি ছিল নিয়ন্ত্রিত ও অগ্রহণযোগ্য। আসন্ন নির্বাচনটিকে মডেল নির্বাচনে পরিণত করতে হলে কমিশনকে এ দুটি নির্বাচন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
নির্বাচন এক দিনের বিষয় নয়—এটি একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার সঠিকতা নিরূপণের জন্য কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড রয়েছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো: ১. নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হতে চান, তাঁরা প্রার্থী হতে পারবেন কি না; ২. ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী থাকবে কি না; ৩. প্রার্থীরা বিনা বাধায় নির্বাচনী প্রচার চালাতে এবং নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারবেন কি না; ৪. যাঁরা ভোট দিতে চান, তাঁরা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন কি না; ৫. ভোটারদের সামনে প্রার্থীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকবে কি না; ৬. অর্থের বিনিময়ে কিংবা সহিংসতার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে কি না; ৭. নির্বাচনে গণমাধ্যম তার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারবে কি না এবং নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি থাকবে কি না; ৮. ইভিএম ব্যবহার কারসাজিমুক্ত এবং ভোট গণনা সঠিকভাবে হবে কি না; ৯. সর্বোপরি ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঠিকতার মানদণ্ডগুলো পূরণ করার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। মডেল নির্বাচনের মানদণ্ডগুলো সঠিকভাবে পূরণ হলো কি না, তা আরও নির্ভর করে সরকার তথা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী তথা সরকারের বাহিনীর ওপর। উচ্চ আদালতেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গাজীপুরের প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মডেল নির্বাচন অনুষ্ঠানের মানদণ্ডগুলো সঠিকভাবেই অর্জিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। দ্য ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে নির্বাচনে ৯৩৪ জন সংবাদকর্মী গাজীপুরে জনগণের ‘চোখ ও কান’ হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়া ৯৪ জন আন্তর্জাতিক এবং ২৩১ জন স্থানীয় পর্যবেক্ষক নির্বাচনের দিনে গাজীপুরে উপস্থিত ছিলেন।
আমাদের সিইসি মহোদয় নিজেই সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, ‘নির্বাচনে যদি বড় দলগুলো একেবারেই অংশগ্রহণ করল না, নির্বাচনের লিগ্যালিটি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু লেজিটিমেসি শূন্যের কোঠায় চলে যেতে পারে।’ (প্রথম আলো, ৭ এপ্রিল ২০২৩)। অর্থাৎ আসন্ন বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের অভাবে গাজীপুর সিটি নির্বাচন লেজিটিমেট বা গ্রহণযোগ্য হবে না।
প্রথম নির্বাচনে নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি সঠিক হওয়ার মূল কারণ ছিল নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন। সে নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোরূপ বাড়াবাড়ি করেনি। আগের অন্য সব কটি—বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর গাজীপুরের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল জেতার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করলেও তারা কোনোরূপ অনিয়মের আশ্রয় নেয়নি। এর মূল কারণ ছিল ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ক্ষমতাসীনেরা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল যে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। তাই ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি নির্বাচন ছিল একটি মডেল নির্বাচন, যাতে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হন।
পক্ষান্তরে, ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচন ছিল একটি চরম পক্ষপাতদুষ্ট, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। ওই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল: ১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রধান বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অনেককে ঘরছাড়া করা, যাতে তাঁরা নির্বাচনী প্রচারে থেকে দূরে থাকেন; ২. নির্বাচনের দিনে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগে এবং তঁাদের দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা; ৩. নির্বাচনের দিনে পরিকল্পিতভাবে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিতে সহায়তা করা; ৪. যেহেতু খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনগুলোতে বিএনপি মনোনীত বিদায়ী মেয়ররা মামলা, গ্রেপ্তার, বরখাস্ত ও উন্নয়ন বরাদ্দপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে এলাকায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি, তাই উন্নয়ন চাইলে সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে—এমন একটি প্রচারণার মাধ্যমে ভোটারদের সিদ্ধান্তকে অযাচিতভাবে প্রভাবিত করা; এবং ৫. এসব অনিয়ম ও বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার ভূমিকা পালন এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। সে নির্বাচনেও বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্টের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক হয়রানির মুখে বিরাট ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।
আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর জয়ের পথে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমও ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আর মাঠে নেই। ফলে ক্ষমতাসীনদের মনোনীত প্রার্থীকে জয়ী করতে সরকারের আর হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই গাজীপুর সিটির নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার পথে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থীর অনুপস্থিতি ছাড়া আর তেমন বড় বাধা নেই। তবে আসন্ন নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে?
নির্বাচন হলো বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার অধিকার, ক্ষমতা ও সুযোগ। তাই নির্বাচনে ভোটারদের সামনে বিকল্প—বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী না থাকলে ভোটারদের বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং সত্যিকারভাবেই নির্বাচন হয় না। এতে জনগণের সম্মতির তথা গণতান্ত্রিক শাসনও প্রতিষ্ঠিত হয় না।
বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যালটে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলেই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হওয়ার সুযোগ থাকে, তা না হলে নির্বাচন হবে অনেকটা একতরফা, যা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয়।
আমাদের সিইসি মহোদয় নিজেই সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, ‘নির্বাচনে যদি বড় দলগুলো একেবারেই অংশগ্রহণ করল না, নির্বাচনের লিগ্যালিটি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু লেজিটিমেসি শূন্যের কোঠায় চলে যেতে পারে।’ (প্রথম আলো, ৭ এপ্রিল ২০২৩)। অর্থাৎ আসন্ন বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের অভাবে গাজীপুর সিটি নির্বাচন লেজিটিমেট বা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আর গ্রহণযোগ্য না হলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যাবে না, যা করা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প না থাকলে নির্বাচনের লিগ্যালিটি বা বৈধতাও ক্ষুণ্ন হবে। সংবিধানবিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের মতে, ‘আমাদের সংবিধান সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাইরে কিছু সমর্থন করে না এবং কোনো আইন যদি এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের জন্য বাধা সৃষ্টি করে, তা সাংবিধানিক মানদণ্ড পূরণ করবে না।’ (কনস্টিটিউশনাল ল, পৃ. ৯৭৩)
প্রসঙ্গত, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কমিশনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পূরণে বাধা হবে কি না, আশা করি সিইসি মহোদয় তা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)