অভিমত
মধ্যপ্রাচ্যে কি নতুন করে যুদ্ধের দামামা বাজছে
গত কয়েক দিনে মধ্যপ্রাচ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে লিখেছেন মো. তৌহিদ হোসেন
এক মাস ধরে দেশে চলমান প্রবল আন্দোলন-বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর আর কোথায় কী ঘটছে, তা থেকে সংগত কারণেই আমাদের মনোযোগ প্রায় পুরোপুরি সরে এসেছে। এমনকি তিন মাস পর অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বা গাজায় গণহত্যাও আমাদের বিবেচনার বাইরে চলে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তো কোনো কথাই নেই।
তাই বলে পৃথিবী কিন্তু স্থির হয়ে বসে নেই। অনেক কিছুই ঘটছে দুনিয়াজুড়ে। গত সপ্তাহে এমন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যে।
২০২৪ সালের ২৭ জুলাই অধিকৃত গোলান মালভূমির একটি দ্রুজ গ্রামে খেলার মাঠে এক বিস্ফোরণে ১২ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হন। ইসরায়েল এ জন্য লেবাননের হিজবুল্লাহকে অভিযুক্ত করে। তবে হিজবুল্লাহ দাবি করে এটা তাদের কাজ নয়। প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল বৈরুতের এক ঘনবসতি এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। এই হামলায় কিছু বেসামরিক ব্যক্তিদের পাশাপাশি হিজবুল্লাহর সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শুকুর নিহত হন।
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে তেহরানে। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তেহরান গিয়েছিলেন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া। যে বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলেন তিনি, জোরালো বিস্ফোরণে সে বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং হানিয়া নিহত হন। হানিয়ার মৃত্যু নিয়ে ইসরায়েল জবাবে কোনো কথা বলেনি। কিন্তু সবাই জানে এটা তাদেরই কাজ।
মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে এবং এর ফলে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা ব্যক্ত করে। এ ক্ষেত্রে কাতারের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র। এই হত্যাকাণ্ডকে কাতার জঘন্য অপরাধ এবং ইসরায়েলের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ বলে বর্ণনা করে। হানিয়া কাতারে আশ্রিত ছিলেন এবং ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল।
মিসর ও জর্ডান এক যৌথ বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়। কুয়েত ও ইরাক হানিয়া হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। বাহরাইন, আমিরাত ও ওমানের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেক হালকা।
এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ সৌদি আরব এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। হানিয়ার ইরান সংযোগের কারণে তাঁর প্রতি সৌদি মনোভাব বরাবরই বিরূপ ছিল। আরব ভূমির বাইরে রাশিয়া ও চীন আর সেই সঙ্গে পাকিস্তান হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই হত্যাকাণ্ডকে একটি ঘৃণ্য কাজ বলে তীব্র নিন্দা করেছেন।
এই দুটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পশ্চিমের প্রতিক্রিয়া হয়েছে অনেকটা প্রত্যাশিত লাইনেই। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমেই বলেছে এতে তারা অংশ নেয়নি এবং এ বিষয়ে তারা অবগতও ছিল না। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ড গাজায় যুদ্ধবিরতি অর্জনের জন্য সহায়ক হবে না। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের অনেকটা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। নির্বাচনে জিততে হলে ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটগুলোতে তাঁর আরব–মুসলিম ভোটগুলো লাগবে।
আমি এক পর্যালোচনায় দেখিয়েছিলাম, যে এই আরব মুসলিম ভোটাররা যদি ২০২০ সালে শুধু ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে ঘরে বসে থাকতেন, বাইডেনের পক্ষে ট্রাম্পকে পরাজিত করা সম্ভব হতো না। গাজা গণহত্যায় ইসরায়েলকে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহযোগিতা করে এই সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হয়েছিলেন বাইডেন।
সম্ভবত এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই হ্যারিস তাঁদের ক্ষোভ প্রশমনে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনে খানিকটা নমনীয়তা নিয়ে আসেন এবং কংগ্রেসে নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় অনুপস্থিত থাকেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে হলে ইহুদি লবিকে অসন্তুষ্ট করা চলবে না। তাই এই দুটি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে কমলা হ্যারিস খুব সাবধানে শব্দ চয়ন করেছেন। হিজবুল্লাহ নেতার মৃত্যুর ব্যাপারে তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষার অধিকার ইসরায়েলের আছে। তবে সঙ্গে যোগ করেছেন, আমাদের অবশ্যই এসব আক্রমণ বন্ধের জন্য কূটনৈতিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল হত্যাকাণ্ডের ওপর কোনো সরাসরি মন্তব্য না করে বরং গুরুত্ব দিয়েছেন উত্তেজনা হ্রাস এবং সংঘাত যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তার ওপর। সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে ইইউ। জার্মানির বিষয়টা বোঝা যায়। ইহুদি নিধনে তাদের পূর্ব ভূমিকার কারণে তারা ইসরায়েলের ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং কখনো কোনো মন্তব্যকে ইসরায়েলবিরোধী বলে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা না যায়, সে ব্যাপারে তারা খুবই সাবধান। জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, এ মুহূর্তে উত্তেজনা নিরসনে আমাদের সবকিছু করতে হবে, যাতে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি উদ্ধারের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে না যায়।
সবশেষে যে দেশটির প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে প্রসঙ্গে আসছি। হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে ইরানে এবং হত্যা করা হয়েছে যাঁকে, তিনি ছিলেন ইরান সরকারের অতিথি। ইরান স্পষ্ট করে বলেছে যে এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে এবং তারা এর প্রতিশোধ নেবে। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আঘাত হানার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে কিছুদিন আগে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গাজা গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আঘাতের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অবশ্য উত্তর দিয়েছিলেন যে সে ক্ষেত্রে তাঁকে সাদ্দাম হোসেনের ভাগ্য বরণ করতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে কি তাহলে একটি ব্যাপক সংঘাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো? আর যদি তা–ই হয়, সে ক্ষেত্রে ইসরায়েল ও ইরানের বাইরে কারাইবা এতে সরাসরি জড়িত হতে পারে? নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী সম্ভাব্য ইরানি আক্রমণের জন্য উচ্চ প্রস্তুতিতে আছে এবং যেকোনো দিক থেকে আক্রমণ এলে আক্রমণকারীকে বড় মূল্য দিতে হবে। ইরানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণের টার্গেট হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রও। কিন্তু তার ধরন কেমন হবে, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।
এই আক্রমণ কি ১৩ এপ্রিলের মতো মুখ রক্ষার আক্রমণ হবে, যা ইরান করেছিল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি আঘাতের পর? নাকি প্রকৃতই একটি ব্যাপক আক্রমণ হবে ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে? যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই এমন একটি যুদ্ধ এখন চাচ্ছে না। কিন্তু যদি এমন কিছু ঘটেই, তাহলে তারা অবশ্যই ইসরায়েলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেবে। পেন্টাগন ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সব মার্কিন সামরিক সম্পদকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
পক্ষান্তরে ইরানের পক্ষে থাকতে পারে কারা? কোনো আরব দেশ তা করবে না, এটা ধরেই নেওয়া যায়। তুরস্কও যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না। ইরানের পক্ষে আছে লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুথিরা আর ইরাকে ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা। আর আছে সিরিয়া, যেখানে বাশার–আল আসাদ নিজেই আছেন বেকায়দায়। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে ইরান হয়তো কিছু সহায়তা পেতে পারে চীন থেকে। রাশিয়া নিজেই ড্রোনের জন্য ইরানের মুখাপেক্ষী।
সবদিক বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি ‘আল আউট’ যুদ্ধের সম্ভাবনা খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র মিলিয়ে ইরান একটা আক্রমণ পরিচালনা করবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, যার ব্যাপকতা বা ক্ষতি হয়তো ১৩ এপ্রিলের চেয়ে কিছু বেশি হবে। বড় কোনো ক্ষতি না হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং আরব দেশগুলো আর উত্তেজনা না বাড়াতে ইসরায়েলকে হয়তো রাজি করাতে পারবে। সমস্যা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং ব্যর্থতা ও দুর্নীতি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রয়োজন একটা চিরস্থায়ী যুদ্ধাবস্থা।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব