অবশেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ৪৩তম বিসিএস থেকে বাদ পড়া ২২৭ জনের কেউ ফৌজদারি অপরাধে জড়িত না থাকলে সবাই নিয়োগ পাবেন। সপ্তাহখানেক সমালোচনার পর অবশেষে ক্লিন ইমেজ তালাশ করতে গিয়ে সরকারের নিজের ইমেজ কিছুটা হলেও বাড়ল।
এটি প্রমাণ করে, জনমত ও নীতিগত সমালোচনা প্রশাসনকে সঠিক পথে এগোতে সহায়তা করছে। তবে যে প্রক্রিয়ায় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তাঁদের আগে বাদ দেওয়া হয়েছিল এবং এ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা কতটুকু ছিল, তা নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকে যায়।
দিন শেষে ৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া ব্যক্তিদের কপাল খুললেও এখনো তালাবদ্ধ অবস্থায় সারদায় বাদ পড়া পুলিশের তিন শতাধিক শিক্ষানবিশ উপপরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে নেওয়া সিদ্ধান্তের কী হবে? বছরব্যাপী প্রশিক্ষণের পর যোগদানের ঠিক পূর্বমুহূর্তে বাদ পড়া সেই এসআইদের সরকার বিবেচনা করবে কি না জানি না।
তবে ৪৩তম বিসিএসে যে অযৌক্তিক বিবেচনায় ২২৭ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে অযৌক্তিকভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে এই সব এসআইকে। ঠুনকো ও ছোটখাটো কিছু বিশৃঙ্খলার অজুহাতে সারদায় গত কয়েক মাসে ঢালাওভাবে প্রশিক্ষণরত এসআইদের চাকরিচ্যুত করে সরকার যে বিতর্ক তৈরি করেছে, সেটিরও যৌক্তিক সমাধান হওয়া দরকার এখন।
এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বা আইনি ইস্যু নয়, বরং মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আলোচনার দাবি রাখে। সেটি করতে না পারলে ভবিষ্যতে যেকোনো সরকার এই অপরিপক্ব–অযৌক্তিক ঘোষণায় অন্যদেরও ছাঁটাইয়ে সুযোগ নেবে, সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্যের বীজ বপন করবে।
গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অন্য কোনো অভিযোগ থাকলে অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা দরকার। কোনো সিদ্ধান্তই যেন রাজনৈতিক বিবেচনা বা চাপের কারণে নেওয়া না হয়। চাকরি হারানো ব্যক্তিদের পরিবারের ওপর যে প্রভাব পড়েছে, তা বিবেচনা করে একটি মানবিক সমাধান খুঁজতে হবে। নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নষ্ট করতে পারে।
এসআই প্রশিক্ষণ নিতে আসা এই তরুণ-তরুণীরা উচ্চশিক্ষিত এবং কঠোর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। বিশেষ করে শারীরিক যোগ্যতায় সবাইকে এক কাতারে দাঁড়াতে হয়েছে। তাঁরা সরকারের অর্থায়নে প্রশিক্ষণ নিয়ে পেশাদার পুলিশ অফিসার হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন। তাহলে ‘নাশতা না খাওয়ার’ মতো অভিযোগ কি আসলেই যথেষ্ট? প্রশ্ন হলো, কেন তারা নাশতা খেতে চায়নি বা কেন তারা ‘হইচই’ করেছিল? সেই কারণগুলো কি গ্রহণযোগ্যভাবে তদন্ত করা হয়েছে? উচ্চ স্বরে কথা বলার অপরাধে চাকরিচ্যুত পৃথিবীর আর কয়টা সভ্য দেশে হয়েছে, আমি জানি না।
৪৩তম বিসিএস বাতিলের বিষয়টি যে রাজনৈতিক মহল থেকে এসেছিল, সেই একই মহল গত বছরের ১৭ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি, পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে, পুলিশ প্রশাসনে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে বিদায় নেওয়ার পূর্বে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে মোট ৮০৩ জনকে নিয়োগ প্রদান করে। এর মধ্যে ২০০ জনের বাড়ি গোপালগঞ্জ এবং ৪০৩ জনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকারীদের হত্যাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য।’
এ ঘোষণার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমরা দেখেছি, ওই ৪০তম ক্যাডেট এসআই ব্যাচে প্রশিক্ষণের জন্য মোট ৮২৩ জনের মধ্যে ২৫২ জন এসআইকে নামকাওয়াস্তে অভিযোগে চাকরিচ্যুত করে রাজনৈতিক মহলটির বাসনা পূরণ করে দিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, চলতি বছর ১ জানুয়ারি পর্যন্ত চার ধাপে মোট ৩২১ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু কেন এমন হবে? অতীতের ভুল থেকে আমরা কি শিক্ষা নিয়েছি?
১৮ বছর আগে একই ধরনের খবর হয়েছিল ২০০৭ সালে। সেই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির শাসনামলে নিয়োগ করা ৫৩৬ জন এসআই, ২২১ জন সার্জেন্টসহ মোট ৭৫৭ জনের চূড়ান্ত নিয়োগ বাতিল করেছিল (প্রথম আলো, ২৩ আগস্ট ২০২৪)। তাঁরাও কি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছিল? যদি পায়, তাহলে আজকে যে মহলটি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের (নিষিদ্ধ) সদস্য হওয়ার জন্য চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে, ২০০৭ সালে এই উপপরিদর্শকদের ছাঁটাইয়ের জন্য তারাও দায়ী।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে চাকরি পেতে রাজনৈতিক পরিচয় থাকাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো বলে অভিযোগ আছে। এ কারণে এই সব চাকরি পেতে প্রার্থীরা চাকরির যোগ্যতা হিসেবে স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে ডিও লেটার সংগ্রহ করতেন কিংবা আবেদনের সঙ্গে সেঁটে দিতেন। আর এ কারণে অনেক রাজনীতিবিমুখ কিংবা সেই দলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখে না, এমন অনেককে এই পথ ধরে এগিয়ে যেতে হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে অবশ্যই তা অপরাধ। যারা এই সব দেখে নিয়োগ দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধী। কিন্তু সারদা একাডেমি সেই কথা বলছে না। এমনকি রাজনৈতিক কারণে ছাঁটাই তা স্বীকার না করে দুর্বল যুক্তি দেখিয়ে বিবৃতি দিয়ে চাকরি কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় কখনোই চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা কিংবা ছাঁটাইয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে না। বরং রাজনৈতিক মতাদর্শকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্যক্তির যোগ্যতাকেই আসল মাপকাঠি ধরা উচিত। যে ছেলে বা মেয়েরা এক বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে কখনো নাশতা খাওয়া নিয়ে গোলমাল করল না, ক্লাসে অমনোযোগী ছিল না, উচ্চ স্বরে কথা বলারও অভিযোগ ছিল না, সেই প্রার্থীদের জন্মস্থান, রাজনৈতিক বিশ্বাস কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ে যৌক্তিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা আমাদের সংবিধান অনুমোদন করে না। বরং পরমতসহিষ্ণুতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক মূল্যায়ন যেকোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বার উন্মোচন করে।
দেড় যুগ পরও যদি আমাদের চিন্তাশীলতা সেই একই জায়গায় আটকে থাকে, তাহলে বলতে হয়, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে এই ৩২১ জনকে ভিত্তিহীন অভিযোগে চাকরিচ্যুতির ঘটনা পুলিশের দলীয়করণের একটি সহজাত চর্চা, যা ভবিষ্যতে পুলিশ বাহিনীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভীতিকর উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে।
গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অন্য কোনো অভিযোগ থাকলে অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা দরকার। কোনো সিদ্ধান্তই যেন রাজনৈতিক চাপের কারণে নেওয়া না হয়। চাকরি হারানো ব্যক্তিদের পরিবারের ওপর যে প্রভাব পড়েছে, তা বিবেচনা করে একটি মানবিক সমাধান খুঁজতে হবে। নিয়োগ ও প্রশিক্ষণপ্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নষ্ট করতে পারে। প্রশাসনের জন্য এটি একটি শিক্ষা হওয়া উচিত যে পেশাদার আচরণ ও মানবিক দৃষ্টিকোণ বজায় রাখা রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
এ সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করে চাকরিচ্যুত এসআইদের ফিরে আনা প্রশাসন ও সরকারের জন্য একটি নৈতিক দায়িত্ব। এটা শুধু চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]