কারাগার থেকে নির্বাচনে জিতে আসা কঠিন, কিন্তু পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ঠিক তা-ই আমরা ঘটতে দেখলাম। ২৪ কোটি মানুষের নিয়ত অস্থিতিশীল দেশ পাকিস্তানে ইমরান খানের এই জয় যুগপৎ সংশয় ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। জনতুষ্টিবাদী ও জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে কঠোরভাবে দমনে সেনাবাহিনীর যে চেষ্টা, তা বুমেরাং হয়ে গেছে। গত এক দশকে জেনারেলদের আধিপত্য এত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কর্তৃত্বপরায়ণরা কঠোরভাবে দমন করার কৌশল প্রয়োগ করে এর আগে অনেকবার জয়লাভ করেছে, কিন্তু এবার আর এই কৌশল কাজে লাগল না। দমন-পীড়নেরও যে একটা সীমা আছে, তারই প্রমাণ করল পাকিস্তানের এই নির্বাচনের ফল।
গত আগস্টে জনপ্রিয় ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিকে পরিণত হওয়া খান গ্রেপ্তার হন। তখন থেকেই নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা ছিল। নির্বাচনের দিন কয়েক আগে তাঁকে আদালত আরও দুটি দণ্ড দেন। তারপরও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ২৬৬টি আসনের মধ্যে ৯৩টি আসন পেয়েছে। কারারুদ্ধ ইমরান বা তাঁরই মতো দেখতে কাউকে আমরা জয়-পরবর্তী ভাষণও দিতে দেখলাম, যদিও ওই ভাষণ ছিল এআই জেনারেটেড।
পিটিআই যে ভোট পেয়েছে, তা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে এই পরিস্থিতি দলগুলোকে অন্তত দীর্ঘ ও জটিল আপসরফায় যুক্ত হতে বাধ্য করবে। এই পরিস্থিতি সম্ভবত ২০২২ সালে খানকে যখন উৎখাত করা হয়েছিল, তার চেয়েও জটিল। ওই সময় দেশটির জেনারেলদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াতেই সরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। পাকিস্তানের গোটা ৭৬ বছরের ইতিহাসে, সেনাবাহিনী হয় প্রত্যক্ষভাবে, নয়তো পর্দার আড়ালে থেকে বেসামরিক সরকারের উত্থান-পতনে কলকাঠি নেড়েছে। এবারই প্রথম যোগ-বিয়োগের খেলায় তারা হেরে গেল।
পাকিস্তানে নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত তাঁর মেয়াদ পুরো করতে পারেননি। বেসামরিক জনতাও দেশের ‘প্রকৃত’ কর্তৃপক্ষকে অন্তত সরাসরি খ্যাপাতে চায়নি। কিন্তু খানকে যখন সরিয়ে দেওয়া হয়, তিনি আরও অনমনীয় হয়ে ওঠেন। তিনি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সমালোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে জনবিক্ষোভের ডাক দেন। এসব বিক্ষোভের কোনো কোনোটি সহিংসও হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটা একটা শিক্ষা। অনেক মূল্য চুকিয়ে বহুদিন বাদে এসে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে, অন্য দেশের ‘স্ট্রং মেন’রা প্রায়ই আস্থা, যোগ্যতা ও শৃঙ্খলার প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কখনো দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে পারে না। পাকিস্তানের বেলায় সেনাবাহিনীর সাধারণের হাতে ক্ষমতা ছাড়ার যে অনিচ্ছা, তা দেশটির রাজনীতিকে ভেঙেচুরে দিয়েছে। এই নির্বাচন তা-ই জানান দিয়ে গেল।
সেনাবাহিনী তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করে, তাঁদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁদের স্বজনদেরও হয়রানি করে। অনেকেই জোর–জুলুমের মুখে পিটিআই ত্যাগ করেন এবং খানকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। সাংবাদিকদের ওপর পিটিআই ও দলটির নিপীড়িত নেতার নাম উল্লেখ করে সংবাদ পরিবেশনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। উপরন্তু পিটিআইকে তাদের প্রতীক ক্রিকেট নিয়েও লড়তে দেওয়া হয়নি। ব্যালটে তাদের প্রতীকই ছিল না। যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ নিরক্ষর, সে দেশের জন্য এমন সিদ্ধান্ত ছিল ভয়ংকর। সমালোচকেরা স্বাভাবিকভাবেই এই নির্বাচনকে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে কম গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলে মন্তব্য করেছেন। এত চেষ্টার পরও (হয়তো চেষ্টার কারণেই), এবারকার নির্বাচনই ছিল সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খান ভূরাজনৈতিক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রমে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। এতে হতাশ হয়ে পড়েছিল বাইডেন প্রশাসন। রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পর খানের মস্কো সফর ছিল বাইডেন প্রশাসনের জন্য অসম্মানজনক। এদিকে পাকিস্তানি গণতন্ত্রের প্রতি বা আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে গণতন্ত্রের যতটুকুই অবশিষ্ট ছিল, তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বিরক্ত হলেও, বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানে নির্বাচন-পূর্ববর্তী দমন-পীড়নমূলক অভিযানের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার ইস্যুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে এ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছিল। জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা খুবই মোলায়েম গলায় বলেন, ‘কিছু জায়গায় উন্নতির সুযোগ আছে...পাকিস্তান এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে আমরা তাদের স্বাগত জানাব।’
নির্বাচনের দিন দীর্ঘ সময়ের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল থাকা এবং ফল ঘোষণায় অনেক দেরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভোট জালিয়াতি হচ্ছে, এমন সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে। সব মিলিয়ে নির্বাচন ঘিরে জমে প্রশ্নের স্তূপ। শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা, ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যাহত হওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানায়। বলা হয়, নির্বাচনে হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ উঠেছে, তার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিত। মোটের ওপর এই। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের উচিত ছিল নির্বাচনের আগেই পাকিস্তানি সেনা নেতৃত্বকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, এমন যেকোনো পদক্ষেপ দুই দেশের সম্পর্কে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব রাখবে।
পাকিস্তানে এখন যে ধরনের জোট সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বৈধতার জন্য তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। খুব সম্ভবত জোটটা হবে নওয়াজ শরিফ এবং পিটিআইবিরোধী অন্য কোনো দলের সঙ্গে। যে চ্যালেঞ্জ এখন তাদের সামনে তা হলো, পাকিস্তানের ভোটাররা ব্যালটেই জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা ক্রমে সেনাবাহিনী ও তাদের প্রক্সিদের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছেন। পাকিস্তানের অর্থনীতির খুবই নাজুক দশা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের জরুরি ঋণসহায়তার ওপর নির্ভর করে বসে আছে দেশটি। এর মধ্যে নতুন করে আবারও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কা আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটা একটা শিক্ষা। অনেক মূল্য চুকিয়ে বহুদিন বাদে এসে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে, অন্য দেশের ‘স্ট্রং মেন’রা প্রায়ই আস্থা, যোগ্যতা ও শৃঙ্খলার প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কখনো দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে পারে না। পাকিস্তানের বেলায় সেনাবাহিনীর সাধারণের হাতে ক্ষমতা ছাড়ার যে অনিচ্ছা, তা দেশটির রাজনীতিকে ভেঙেচুরে দিয়েছে। এই নির্বাচন তা-ই জানান দিয়ে গেল।
● ডেভিড শিপলে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সম্পাদকীয় বিভাগের সম্পাদক ● চার্লস লেন উপসম্পাদক ও ● স্টিফেন স্টর্মবার্গ উপসম্পাদক
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সম্পাদকীয় বোর্ডের মতামত হিসেবে নিবন্ধটি ছাপা হয়েছে