ট্রাম্প প্রশাসনে ভারতীয়দের নিয়ে বিতর্ক কেন? 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বিবেক রামাস্বামীরয়টার্স

নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মূল স্লোগান হলো ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (আমেরিকাকে আবার মহান করো)। সংক্ষেপে একে বলা হয় ‘মাগা’। এই মাগা আন্দোলনের ভেতরে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তাতে ভারতের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। এটা হয়তো অবাক করার মতো নয়। মাগার মধ্যে দ্বন্দ্বরত দুটি পক্ষের মধ্যে ভারতকে ঘিরে একটি বিভাজন তৈরি হয়েছে।

একদিকে রয়েছে তারা, যারা মনে করে আমেরিকাকে মহান করতে হলে বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক কমাতে হবে, কর কমাতে হবে এবং ব্যবসার জন্য শিথিল নিয়মকানুন চালু করতে হবে। তাদের মতে, সরকারের আকার ছোট করে সারা বিশ্ব থেকে সেরা প্রতিভা নিয়ে এসে ব্যবসা-বাণিজ্যে জোয়ার আনার মাধ্যমেই এই কাজ সম্ভব।

অন্যদিকে আরেকটি গোষ্ঠীর মতে, মাগা হলো বহু সংস্কৃতিবাদ, কসমোপলিটানিজম (বিশ্বজনীন জীবনধারা) এবং আমেরিকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। তাদের বিশ্বাস, আমেরিকার মহান হওয়া মানে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ–সংস্কৃতি।

এই দুই দলের জন্যই ভারত এখন একটি বড় উদাহরণ। ভারতীয়দের অনেকেই একটি ‘আদর্শ সংখ্যালঘু’ হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয়দের ৭২ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। ভারতীয় অভিবাসীরা সাধারণত অভিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সর্বোচ্চ আয় করেন।

গত ২৫ বছরে সিলিকন ভ্যালির ২৫ শতাংশ স্টার্টআপ ভারতীয় বা ভারতীয়-আমেরিকানদের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে। এমনকি গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাডোবি ও আইবিএমের মতো বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির নেতৃত্বেও রয়েছেন ভারতীয়রা।

বিষয়টি থেকে বোঝা যায় যে কেন অর্থনীতিকেন্দ্রিক মাগা গোষ্ঠী ট্রাম্পের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বেশ কিছু ভারতীয়-আমেরিকানকে মনোনীত করে খুশি। যেমন জে ভট্টাচার্যকে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ পরিচালনার জন্য) এবং কাশ্যপ প্যাটেলকে (এফবিআইয়ের প্রধান) মনোনীত করা হয়েছে। ট্রাম্প বিবেক রামাস্বামীকে ইলন মাস্কের সঙ্গে ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’ নামে একটি উপদেষ্টা কমিশনের সহপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এই কমিশনের লক্ষ্য কেন্দ্রীয় বাজেট কমানো। 

 তবে মাগার শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এই নিয়োগগুলো নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। চেন্নাইয়ে জন্মগ্রহণকারী ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট শ্রীরাম কৃষ্ণানকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ নীতিনির্ধারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণায় তাদের রাগ চরমে পৌঁছায়। এক্সে (সাবেক টুইটার) একজন লিখেছেন, ‘আপনারা কি কেউ এই ভারতীয়কে আমেরিকা চালানোর জন্য ভোট দিয়েছেন?’ 

এ কথা সত্যি যে অভিবাসনের বিরোধিতার পেছনে সব সময় বর্ণবাদ একমাত্র কারণ নয়। খান্না এবং থানেদারের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় যে অনেক আমেরিকান চাকরির প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিশেষত এমন সময়ে, যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে দ্রুত কর্মী ছাঁটাইয়ের হুমকি তৈরি করছে। 

মাগার শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের সমস্যা শুধু ‘এই ভারতীয়’ নিয়েই নয়। ২০২২ সালে ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নেন। এরপর তিনি শ্রীরাম কৃষ্ণানকে কোম্পানিটি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৪ নভেম্বর মাস্ক এক্সে একটি পোস্ট দেন। বিষয় ছিল ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি কীভাবে চালালে ভালো হয়। কৃষ্ণান সেই পোস্টে উত্তর দেন, ‘গ্রিন কার্ডের জন্য দেশভিত্তিক কোটা সরিয়ে দক্ষ অভিবাসনকে উন্মুক্ত করা বড় পরিবর্তন আনতে পারে।’

পরের মাসে ট্রাম্প কৃষ্ণানকে সেই ডিপার্টমেন্টে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা করলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মাগার একজন বিশিষ্ট কর্মী লরা লুমার এই ঘোষণাকে ‘মারাত্মক বিরক্তিকর’ বলে উল্লেখ করেন।

তিনি এক উত্তেজিত এবং কিছুটা অগোছালো পোস্টে প্রশ্ন তোলেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করবে এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি চালু রাখবে, যখন এমন একজন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পান, যিনি ‘সব গ্রিন কার্ড কোটার সীমা সরাতে চান?’ লুমারের দাবি, এমন হলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এমন চাকরি নেওয়ার সুযোগ পাবেন, যা মূলত আমেরিকানদের পাওয়া উচিত। 

কিন্তু কৃষ্ণান আসলে কেবল দেশভিত্তিক কোটা তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। এই কোটা প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য গ্রিন কার্ডের (মার্কিন স্থায়ী বসবাসের ভিসা) সংখ্যা বেঁধে দেয়। আর এর ফলে বড় দেশগুলো, বিশেষত ভারতের মতো যেসব দেশে অনেক দক্ষ কর্মী রয়েছেন, তাঁদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

ডেভিড স্যাকস ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্রিপ্টো উপদেষ্টার পদে মনোনীত হয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিটি দেশকে সমানসংখ্যক গ্রিন কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা সেসব যতই যোগ্য প্রার্থী থাকুক না কেন। ফলে ভারতের অনেক আবেদনকারীদের ১১ বছরের বেশি অপেক্ষায় থাকতে হয়। অথচ অনেক দেশের আবেদনকারীদের কোনো অপেক্ষাই করতে হয় না।

বাস্তবে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের জন্য যে এইচওয়ান-বি ভিসা দেওয়া হয়, তার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ভারতীয়রা ধরে রাখেন। তবে তাঁরা মোট গ্রিন কার্ডের মাত্র ৭ শতাংশের দাবিদার। মাগা আন্দোলনের অর্থনীতিকেন্দ্রিক গোষ্ঠী চায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘মহানত্ব’ বজায় রাখার জন্য বিশ্বের সেরা ও সবচেয়ে মেধাবী ব্যক্তিদের বৈধ অভিবাসনের মাধ্যমে আমেরিকায় নিয়ে আসতে। কিন্তু লুমার এবং তাঁর সমমনা গোষ্ঠীর কাছে অভিবাসন পুরোপুরিই একটা সমস্যা। তাঁদের মতে, অভিবাসনের ফলে আমেরিকার খ্রিষ্টান এবং ইউরোপীয় জাতীয় চরিত্র হুমকির মুখে পড়ে। ফলে বিদেশিরা ‘আমেরিকানদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার’ সুযোগ পান।

ডানপন্থী বিশ্লেষক অ্যান কোল্টার এ বছর সাবেক রিপাবলিকান প্রার্থী বিবেক রামাস্বামীর উদ্দেশে বলেছিলেন, তিনি তাঁর অনেক মতের সঙ্গে একমত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ভোট দিতেন না। কারণ, তিনি ভারতীয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত দুই কংগ্রেস সদস্য, রো খান্না এবং শ্রী থানেদার সাম্প্রতিক সময়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন।

খান্না বলেছিলেন যে কৃষ্ণানের মতো প্রতিভাবানেরা চীনে না গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে চাইছেন, বিষয়টি উদ্‌যাপন করা উচিত। কিন্তু তাঁর এই মন্তব্যের জবাবে এমন মন্তব্য পাওয়া গেছে, ‘তাঁরা এতই ভালো হলে নিজের দেশ ঠিক করলেন না কেন?’ আরেকজন বলেছিলেন, ‘আমরা সাদা অভিবাসী চাই, বাদামি অনুপ্রবেশকারী বাহিনী নয়।’ 

শ্রী থানেদার যখন এইচ-ওয়ানবি ভিসা বিতর্কে ভারতীয়-আমেরিকানদের লক্ষ্য করে করা ‘জঘন্য মন্তব্য’-এর নিন্দা করেন, তখন তাঁর প্রতিও বর্ণবাদী আক্রমণ শুরু হয়। এক এক্স ব্যবহারকারী লেখেন, ‘তোমার জন্য মুম্বাইয়ের একমুখী টিকিট কিনে দিতে পারি?’ আরেকজন মন্তব্য করেন, ‘তুমি একজন বিদেশি, তোমার দেশের লোকজনকে আমার দেশে নিয়ে আসার জন্য পক্ষে প্রচার চালাচ্ছ, যাতে তারা আমার লোকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে?’

এ কথা সত্যি যে অভিবাসনের বিরোধিতার পেছনে সব সময় বর্ণবাদ একমাত্র কারণ নয়। খান্না এবং থানেদারের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় যে অনেক আমেরিকান চাকরির প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিশেষত এমন সময়ে, যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে দ্রুত কর্মী ছাঁটাইয়ের হুমকি তৈরি করছে।

মাগা আন্দোলনের দুই পক্ষকেই সন্তুষ্ট করার একটি সহজ সমাধান আছে বলে মনে হয়। ভারতীয় কর্মীদের আমদানি করার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের উদ্ভাবন ভারতের কাছেই আউটসোর্স করতে পারে। যদি মার্কিন বিনিয়োগকারীরা উন্নত গবেষণা এবং উদ্ভাবন চালিয়ে যেতে সক্ষম, এমন ভারতীয় সংস্থাগুলোতে অর্থায়ন করেন, তবে যুক্তরাষ্ট্র উদ্ভাবন এবং গতিশীলতার সুফল পেতে পারে অভিবাসনপ্রবাহ না বাড়িয়েই।

তবে যাঁরা বর্ণবাদী মনোভাব পোষণ করেন, তাঁদের জন্য সতর্কবার্তা আছে। এই পদ্ধতিতে ভারতও লাভবান হবে। এর অর্থ হলো, মাগাকে একটু বাড়িয়ে তখন ‘মেইক আমেরিকা অ্যান্ড ইন্ডিয়া গ্রেট অ্যাগেইন করতে হবে!’

 ● শশী থারুর ভারতীয় সংসদ সদস্য ও লেখক 

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন