৯ অক্টোবর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলে হাঙ্গেরির সভাপতিত্ব কেন করা দরকার, সে বিষয়ে কথা বলেন। তাঁর এ বক্তব্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বড় অংশটি প্রশংসা করে। কয়েকজন সদস্য বের হয়ে যান বক্তব্য শুরুর আগে।
এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে ইউরোপের মূলধারার রাজনীতিবিদদের কাছে ওরবান ভীতিকর এক চরিত্র। এর কারণ শুধু এটা নয় যে তিনি ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনকে ক্ষমাহীনভাবে আলিঙ্গন করে নিয়েছেন। তিনি পূর্ব ইউরোপ ও অন্যখানে তাঁর অনুরাগীদের মধ্যে একটি কাল্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তরতাজা উদাহরণটা এসেছে নর্থ মেসিডোনিয়া থেকে। ২৬ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শহর ওহরিদে মেসিডোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হ্রিস্টিজান মিকোস্কির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি নায়কোচিত সংবর্ধনা পান। ওরবান আয়োজক দেশের জন্য একটি মূল্যবান উপহার নিয়ে যান। আর সেটা হলো ৫৩৯ মিলিয়ন ডলারের ঋণ। এ ঋণের অর্ধেকটা নর্থ মেসিডোনিয়ার স্থানীয় সরকারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এক বছরের মধ্যে নর্থ মেসিডোনিয়ার স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে এই ঋণ সরকারি দলের জন্য একটি নির্বাচনী প্রণোদনা। দীর্ঘদিন পর এ বছরের মে মাসে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল দেশটির ক্ষমতায় এসেছে। ওরবানের সহযোগিতা নিয়ে তারা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার আশা করছে।
ওরবান মনে করেন, পশ্চিম বলকানের দেশগুলোর দীর্ঘদিন আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়া উচিত ছিল। আলবেনিয়ার সঙ্গে বিতর্কের কারণে তিন দশক ধরে রাজনৈতিক বাধার মুখে রয়েছে নর্থ মেসিডেনিয়া। গ্রিসকে সরিয়ে বুলগেরিয়া এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে মেসিডোনিয়ার সদস্য পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। ওরবান এ ক্ষেত্রে বুলগেরিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
বলা হয়, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঘটনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কলেবর বাড়ানোর ধারণাটিকে পুনজ্জীবিত করেছে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা ক্লাবে পুতিনের সেরা বন্ধুরা এখন ইইউতে নতুন সদস্য যুক্ত করার পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ।
মিকোস্কির মতো সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দ্রার ভুচিচ ও জর্জিয়ার রাজনীতির ‘পুতুল খেলার বাজিগর’ বিডজিনা ইভানিশভিলির মতো নেতারা ওরবানকে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করেন না, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চিন্তার অনুসারীও তাঁরা।
জুলাই মাসে ২৭টি দেশের একটি জোটের প্রতিনিধিত্ব দাবি করে ওরবান একটি শান্তি মিশনে মস্কো সফর করেন। এ ঘটনায় সদস্যদেশগুলো তীব্র সমালোচনা ও আপত্তি থাকলেও ওরবান চীন ও ব্রাজিলের সমর্থন নিয়ে ইউক্রেনের জন্য একটি শান্তি পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছেন।
রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প হাঙ্গেরির ভিক্তর ওরবানের প্রতি তাঁর অনুরাগ গোপন করেননি। গত মাসে টেলিভিশন বিতর্কে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসের প্রতি কটাক্ষ করে বলেন, ‘আমাকে বিশ্বনেতাদের মধ্যে ভিক্তর ওরবানের কথা বলতে দিন, তিনি একজন সম্মানিত লোক। তাঁকে তারা শক্তিশালী লোক বলে। কিন্তু তিনি একজন কঠোর ব্যক্তি ও হাঙ্গেরির স্মার্ট প্রধানমন্ত্রী।’
ট্রাম্প এ ক্ষেত্রে শুধু একা নন। রিপাবলিকানদের অনেক নেতাই তাঁর প্রতি মোহগ্রস্ত। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ওরবানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে উপেক্ষা করে তাঁকে ‘অভিবাসীবিরোধী’ একজন শক্তপোক্ত নেতা বলে মনে করেন তাঁরা।
চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে অন্য দেশের লেনদেনের ক্ষেত্রে একটা মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি হিসেবেও কাজ করেন ওরবান। এ বছরের শুরুর দিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর ইউরোপ সফরের একটি দেশ হিসেবে হাঙ্গেরিকে বেছে নিয়েছিলেন। জানা যাচ্ছে, মেসিডোনিয়ার ঋণ এসেছে বেইজিং থেকে এবং তা হাঙ্গেরির মধ্যস্থতায়।
জুলাই মাসে ২৭টি দেশের একটি জোটের প্রতিনিধিত্ব দাবি করে ওরবান একটি শান্তি মিশনে মস্কো সফর করেন। এ ঘটনায় সদস্যদেশগুলো তীব্র সমালোচনা ও আপত্তি থাকলেও ওরবান চীন ও ব্রাজিলের সমর্থন নিয়ে ইউক্রেনের জন্য একটি শান্তি পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছেন।
ওরবানের আন্তর্জাতিক নেতা হওয়ার অভিলাষ শুধু পূর্ব ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গত মাসে তাঁর সরকার চাদে একটি সামরিক মিশন পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। আফ্রিকার সাব-সাহারা থেকে অভিবাসীদের ইউরোপে আসা ঠেকাতে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সার্বিয়া, জর্জিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত না হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এ দেশগুলো ওরবানের অনুগত দেশ হিসেবে সদস্য হতে চায়।
যদিও হাঙ্গেরিতে ওরবানতন্ত্র তার স্বর্ণসময়টা পার করে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি সদস্যগুলো ওরবানের প্রতি তাদের অবস্থান শক্ত করেছে এবং কয়েক বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করেছে। বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক মেয়র পিটার ম্যাগারের কাছে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ওরবানকে। ২০২৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না, কিন্তু ওরবান নিশ্চিত করেই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে।
● দিমিতার বেচেভ কার্নেগি ইউরোপের সিনিয়র ফেলো
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত