গাজা যুদ্ধের দ্বিতীয় মাস শুরু হয়েছে। দুটি প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। এক. কোন ধরনের সংঘাত আমরা দেখছি? দুই. এই সংঘাত কত দিন স্থায়ী হবে? দুটি প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই আমাদের আধুনিক যুদ্ধের প্রবণতা সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করে। শুধু নাইন–ইলেভেনের পরবর্তী ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’-এর প্রেক্ষাপট থেকে নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বিদ্রোহের পেছনে যেসব কারণ থাকে, তার সমাধান না করে, জবরদস্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন। নেতানিয়াহুর এ বক্তব্য নাইন–ইলেভেনের পর জর্জ ডব্লিউ বুশ আল-কায়েদা ও তালেবান নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যে ভৌতিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে মিলে যায়। বুশের সেই ঘোষণা বিশ্বে মারাত্মক পরিণতি ডেকে এনেছিল, বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইরাকে।
যুদ্ধের এক মাস পর দেখা যাচ্ছে, নেতানিয়াহু হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই যুদ্ধে নেমেছেন। ইসরায়েল গাজাকে শুধু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখবে না, দীর্ঘদিনের জন্য গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ইসরায়েলের। কেননা, আমরা দেখেছি, সেটা না থাকলে কী ঘটতে পারে।’
নেতানিয়াহুর ঘোষণা অনুযায়ী, ইসরায়েল যদি হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেও পারে (এই প্রচেষ্টা যে সমস্যাজনক, তার দৃষ্টান্ত এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে) তারপরও হামাস সৃষ্টির পেছনে যে ধারণা ও প্রেরণা, সেটা থেকেই যাবে। এই যুদ্ধে যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তাতে করে হাজার হাজার তরুণের ওপর নিশ্চিতভাবেই সেটা আরও বেশি প্রভাব ফেলবে।
গাজা যুদ্ধ হচ্ছে সেই আয়না, যেটা আমাদের দেখায়—ন্যায্যতা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে জন্ম নেওয়া একটি সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বিশ্ব কীভাবে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধের মানে হচ্ছে বিশ্বে অস্ত্রশিল্পের সমৃদ্ধি। দেশে দেশে সামরিক ব্যয় আকাশ স্পর্শ করছে।
গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত চার হাজারের বেশি শিশুসহ ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা শহরের বিরাট একটি অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বর্তমানে গাজায় ঢুকে হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ধীরগতিতে যুদ্ধ করতে চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। প্রথম কয়েক দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের ২৬০ জন সেনা আহত হয়েছেন। যদিও গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ এখনো শুরুই হয়নি।
ইউক্রেনের মারিউপোলে রাশিয়ান বাহিনী (২০২২) এবং ইরাকের মসুলে (২০১৬), সিরিয়ার রাকায় (২০১৭) ও ইরাকের ফালুজায় (২০০৪) পশ্চিমা বাহিনীর যুদ্ধ—আমাদের দেখিয়েছে যে শহর অঞ্চলের যুদ্ধে বিমানবাহিনীকে ব্যবহার ও নির্বিচার বোমা হামলায় বেসামরিক মানুষের ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজাতেও সেটা আমরা দেখছি। কিন্তু একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচনা বাড়ছে। সময় এখন মোটেই ইসরায়েলের পক্ষে নয়।
এই পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি হলো? গত মাসের আগপর্যন্ত সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ব্যবহার, ফিলিস্তিনিদের ওপর বিরামহীন নিয়ন্ত্রণ ও উঁচু মাত্রার নজরদারি এবং জনবল ও প্রযুক্তি বলে সুদক্ষ গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার মাধ্যমে ইসরায়েল তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত। এটা নিয়ন্ত্রণ করার সেই প্রক্রিয়া, যেখানে তাপ প্রশমনের ব্যবস্থা না করে বোতলের ছিপি উল্টো এঁটে দেওয়া হয়। এর বৈশ্বিক পরিণতিও ভয়াবহ হয়।
আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া কিংবা অন্য যেকোনো যুদ্ধ আমাদের বারবার করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সামরিক অভিযান কতটা সমস্যা তৈরি করে। নাইন–ইলেভেন পরবর্তী যুদ্ধগুলোয় ৯ লাখ মানুষ সরাসরি নিহত হয়েছেন। আরও ৩৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে যুদ্ধের কারণে মারা গেছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ।
গাজা যুদ্ধ হচ্ছে সেই আয়না, যেটা আমাদের দেখায়—ন্যায্যতা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে জন্ম নেওয়া একটি সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বিশ্ব কীভাবে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধের মানে হচ্ছে বিশ্বে অস্ত্রশিল্পের সমৃদ্ধি। দেশে দেশে সামরিক ব্যয় আকাশ স্পর্শ করছে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ
পল রজার্স যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি অধ্যয়নের ইমেরিটাস অধ্যাপক