যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ক্ষমতার খেলায় প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ

সলোমন দ্বীপপুঞ্জসহ অন্য দ্বীপগুলোতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে চীনছবি: রয়টার্স

এশিয়ার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই দ্বীপগুলোতে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করে চলেছে। এসব দ্বীপ এবং সেগুলো ঘিরে যে বলয়, সেখানে দেশ দুটি নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। 

আমরা জানি, সমুদ্রে রাজনীতি যখন প্রবেশ করে, তখন সেটি উত্তপ্ত প্রতিযোগিতার স্থান হয়ে ওঠে। আর নিরাপত্তার প্রশ্নে দ্বীপগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের স্বার্থ বিরাটভাবে বেড়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা (বিশেষ করে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া) প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। চীনকে মোকাবিলা করার প্রচেষ্টা হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে ৮০ বছরের মধ্যে এই প্রথম তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে।

বিশ্বের যেখানে অবস্থিত হোক না কেন, দ্বীপ সব সময়ই সম্পদের ভান্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর সুনির্দিষ্ট তাৎপর্যের কারণ দুটি। এক. এক দ্বীপের সঙ্গে অন্য দ্বীপের মধ্যকার দূরত্বটা অনেক বেশি। দুই. ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে দ্বীপগুলোর একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি মূলত কয়েকটি বড় ঘাঁটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে গুয়ামের অ্যান্ডারসন বিমানঘাঁটি এবং জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপের কাদেনা বিমানঘাঁটি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আমেরিকান সামরিক সক্ষমতা কয়েকটি দ্বীপে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকায় বড় একটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রতিপক্ষ যদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা আঘাত করার সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যাবে। যা–ই হোক, প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের গতিবিধির সঙ্গে তাল মেলাতে যুক্তরাষ্ট্রও জুয়া খেলায় নেমেছে।

প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের কর্মতৎপরতাকে ‘গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলা হুমকি’ বলে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, যত দিন যাচ্ছে, চীনের এই হুমকি ততই বাড়ছে। ধীরে ধীরে বড় এলাকাজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে ওই অঞ্চলে স্থিতাবস্থা বদলে দেওয়ার পথ খুঁজছে চীন। নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বদলে দেওয়ার পথ খুঁজছে বেইজিং। প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর জবরদস্তি করার ক্ষেত্রে চীনের সক্ষমতা বাড়ছেই। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটন ও এর মিত্রদেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বেইজিং। 

প্রশান্ত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে চীনের কৌশলনীতি দিনে দিনে প্রভাববিস্তারী হয়ে উঠছে। উদাহরণ হিসেবে ২০১৯ সালে দ্বীপদেশ কিরিবাতি তাইওয়ানকে রেখে চীনের ওপর কূটনৈতিক সমর্থন দেয়। পাপুয়া নিউগিনিতে হুয়াওয়ের উপাত্ত সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে চীন। ফিজির পুলিশ বিভাগের সঙ্গে নানা প্রকল্পে জড়িয়েছে চীন। সলোমন দ্বীপপুঞ্জসহ কয়েকটি জায়গায় গবেষণাকেন্দ্র করেছে। সামোয়াতে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। ওয়াশিংটন মনে করে, এ ধরনের ভাষাশিক্ষার কেন্দ্রটি চীনের প্রভাব বিস্তারে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওশেনিয়া অঞ্চলে চীন ধ্রুপদি চীনা মতাদর্শ প্রয়োগ করছে। এই মতাদর্শের কেন্দ্রে রয়েছে তিন যুদ্ধ—মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, গণমাধ্যম অথবা জনমত যুদ্ধ ও আইনি যুদ্ধ। আইনি ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার পদ্ধতি।

দৃষ্টান্ত হিসেবে, সলোমন দ্বীপপুঞ্জে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে উত্তেজনা তৈরি করছে চীন। দেশটিতে বেকারত্বের হার এখন অনেক বেশি। এর ফলে সেখানে আরও উত্তেজনা ছড়ানো ও নিজেদের প্রভাব তৈরির সুযোগ পাচ্ছে চীন। সলোমন দ্বীপপুঞ্জে যদি অস্থিতিশীলতা তৈরি করা যায়, তাহলে তার প্রভাব অন্য দ্বীপগুলোরও ওপরে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তাতে করে এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ—দুইয়ের স্বার্থের ওপর চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।

চীনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর বিমানক্ষেত্রগুলোর ওপর জোর দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আবার মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের তিনিয়ানকে বিমান ও নৌকর্মকাণ্ডের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ১০১ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপটিতে মাত্র তিন হাজার মানুষ বাস করে, কিন্তু দ্বীপটির কয়েকটি বিমানবন্দর নানা ধরনের সেবা দিয়ে চলেছে।

কৌশলগতভাবে তিনিয়ান, সাইপান ও গুয়াম দ্বীপপুঞ্জে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান পরিচালনার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এই তিনটি দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানবাহী রণতরি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্থায়ী রূপ নিতে চলেছে।

থিওডর কারাসিক ওয়াশিংটনভিত্তিক ভূরাজনৈতিক পরামর্শক সংস্থা গালফ স্টেট অ্যানালিটিকসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা

আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত